শহীদ বেরেলভী (রহ.) ও বালাকোটের যুদ্ধ

// এবাদত আলী//
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সিপাহশালার, শহীদে বালাকোট, আওলাদে রাসুল (সা.), সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী (রহ.) ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা জেলায় এক প্রসিদ্ধ বংশে ১৭৮৬ সালের ২৯ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বংশ তালিকা চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) এর সাথে মিলিত হয়েছে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন রায় বেরেলিতেই শুরু হয়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পিতার ইন্তেকালের পর ভারতের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ইসহাক দেহলভী (র.) এর কাছ থেকে ইলমে শরীয়তের পান্ডিত্ব অর্জন করেন। পরবর্তিতে অনেক দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে দিল্লীতে এসে ইমামুল মুহাদ্দিসিন শায়খুল মাশায়েখ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। তিনি অতি অল্প দিনেই এলমে তাসাউফের সু-উচ্চ মাকামে আরোহন করেন এবং শাহ সাহেব তাঁকে খেলাফত দান করেন।
খিলাফত লাভের পর বেরেলভী (রহ.) কঠিনভাবে রিয়াজত, মুশাক্কাতে আত্মনিয়োগ করায় ইলমে বাতেনের সকল মাকামই অতি সহজে তার আয়ত্ব হয়েছিলো। তাঁর পীর হজরত শাহ সাহেবের নিকট কোন লোক মুরিদ হতে আসলে তিনি তাদেরকে হজরত বেরেলভী (রহ,) এর নিকট পাঠিয়ে দিতেন এবং বলতেন আমার কাছ থেকে ১২ বছরে যা হাসিল করতে পারবেনা, বেরেলভীর কাছ থেকে তা ১২ দিনে আয়ত্ব করতে পারবে।
তাঁর তরিকার নাম ত্বরিকায়ে মোহাম্মাদিয়া। এই তরিকা মানুষকে দেখিয়েছে একটি আলোকজ্জোল পথ। তিনি ১৮২২ সালে ৭৫৩ জন যাত্রি নিয়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে হজ পালন এবং মদীনা শরীফে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর রওজা শরীফ জিয়ারত করেন। ১৮২৪ সালে তিনি রায়বেরলিতে ফিরে আসেন।
পরাধীন ভারতবাসির কেউ তখনো বৃটিশদের শাসন ও শোষণ থেকে রক্ষার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেনি। সাধারণ মানুষ কখনোই ভাবতোনা তারা বৃটিশদের জুলুম নির্যাতন ও শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারবে। এমনই এক সময় বেরেলভীর আবির্ভাব ঘটেছিলো যখন ভারতের মুসলমানদের ওপর ইংরেজ, শিখ ও হিন্দুদের অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। জুলুম-নির্যাতন এতই বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে, জালিমরা মুসলিম নারীদের দাসি রূপে ব্যবহার করতো। ফসলাদি নষ্ট ও ঘর-বাড়িতে আগুন দেওয়াসহ সিমান্তের মসজিদগুলোকে মন্দির ও ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করেছিলো। সর্বোপরি একদিকে মুসলমানরা বিধর্মীদের হাতে লাঞ্চিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত হচ্ছিলো, অন্য দিকে বৃটিশ, হিন্দু ও শিখদের প্রতিপত্তির ফলে নিজস্ব তাহজিব তামাদ্দুন তথা মুল আদর্শ, সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে পাশ্চাত্য ও হিন্দুয়ানি আদর্শ, সংস্কৃতি গ্রহণ করা শুরু করেছিলো। এমনকি বিভিন্ন এলাকায় মুসলমানরা হিন্দুদের পোশাক পরিচ্ছদ ব্যবহার করাসহ তাদের নামের পুর্বে শ্রী শব্দ পর্যন্ত ব্যবহার করতো।
ঠিক সেই মূহুর্তে আজাদী আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সিপাহশালার, শহীদে বালাকোট, আওলাদে রাসুল সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রহ.)।
রেনেসার কবি ফররুখ আহমদ তাই সৈয়দ আহমদ বেরেলভী সম্পর্কে তার কালজয়ী কবিতায় রায় বেরেলভীর জঙ্গি পীর আখ্যা দিয়ে লিখেছিলেন,‘‘ সবাই যখন আরাম খুজে/ ছুটে ঘরের পানে। জঙ্গি পীরের ডাক শোনা যায় / জঙ্গেরই ময়দানে। সবাই ভাবে পীরের কথা/ শুনেছিতো ঢের। এমন পীরের কথা তো ভাই পাইনি কভু টের।’’
গভীর রাতে প্রকৃত আল্লাহওয়ালাদের দুচোখে যেমন অশ্রু ঝরে, ঠিক তেমনিভাবে দিনের আলোতে তার তরবারিতে ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমনদের রক্ত ঝরে। তিনি শুধু মুরিদানদের নিয়ে তসবিহ হাতে জায়নামাজে খানকায় বসে থাকেন নি। নিজের সুখ-শান্তি ত্যাগ করে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে একদল বিশুদ্ধ আত্মার নিবেদিত প্রাণকর্মি বাহিনী নিয়ে সিংহের মত গর্জে উঠেছেন। তিনি ১৮৩১ সালের ৬ মে ঔতিহাসিক বালাকোট প্রান্তরে ইংরেজ ও শিখ মিত্র বাহিনীর সাথে জিহাদ করেছিলেন।
সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.) এর বাহিনীর সাথে ইতোপুর্বে কয়েকটি যুদ্ধে শিখ ও বৃটিশ বাহিনী পরাজিত হয়। বীর মুজাহিদ বাহিনীর সাথে কোনমতেই টিকে ওঠা সম্ভব নয় ভেবে বৃটিশ ও শিখ নরপতিগণ কুটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। মুসলমান সামাজে বিশ^াসঘাতক তথা মুনাফেকদের অভাব কোনকালেই ছিলোনা। সীমান্তের প্রধান জমিদার ও গোত্রপতিগণকে ইংরেজ ও শিখ শাসকেরা বিভিন্ন প্রকার লোভ দেখিয়ে বশীভুত করে ফেলে। তারা মুজাহিদদের যাবতীয় তথ্যাদি ইংরেজ ও শিখদের নিকট গোপনে সরবরাহ করতে থাকে।
মুজহিদ বাহিনী এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। তাদের বাহিনীতে মাত্র ৭শ সৈন্য এবং শিখ সৈন্য সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার। ১৮৩১ সালের ৬ মে তারিখে বালাকোটের যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনী যে জায়গায় অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে পাহাড়ি পিরিপথ মাড়িয়ে শিখ বাহিনী এতসহজে তথায় পৌঁছতে সক্ষম হতোনা। কিন্তু স্থানীয় মুসলমান মুনাফেকদের কারণে বালাকোট পর্যন্ত পৌঁছার রাস্তা পেয়ে যায় শিখ বাহিনী। এই যুদ্ধে শিখ বাহিনীর প্রায় ১ হাজার সৈন্য নিহত হয়।
ঐতিহাসিক এই বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.) ১২৪৬ হিজরী সনের ২৪ জিলক্বদ তারিখে সাহাদত বরণ করেন। তার সাথে প্রায় ৩শ বীর মুজাহিদও সাহাদত বরণ করেন।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী,
সাংবাদিক ও কলামিস্ট,