// ইকবাল কবীর রনজু, পাবনা
পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের চলনবিল অধ্যুষিত এলাকার নদ নদীগুলোতে পানি না থাকায় চলনবিলের সব নৌরুট বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতি বছর মাঘ-ফাল্গুন মাস আসতে না আসতেই পানিশূন্য হয়ে পরছে এ এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল। এর ফলে ব্যহত হচ্ছে সেচ ব্যবস্থা। বিলুপ্ত হচ্ছে নানান প্রজাতির দেশী মৎস সম্পদ।
পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের গুরুদাসপুর, রড়াইগ্রাম ও সিংড়া, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়ার আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত চলনবিল। এ এলাকার অধিকাংশ নদ নদীই দীর্ঘদিন খনন করা হয়নি। ফলে নাব্যতা সংকট বাড়ছেই। অপরিকল্পিত ভাবে আত্রাই, গুমানীসহ দু-একটি নদী খনন করা হলেও তার সুফল পাচ্ছেন না এ এলাকার মানুষ।
অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থ থেকে জানা যায়, জলপাইগুড়ির পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া আত্রাই ও গুর নদী রাজশাহীতে এসে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পরে। এর একটি শাখা কয়রাবাড়ি, নন্দনালী, ও আত্রাই হয়ে আত্রাই ঘাটের এক মাইল নিম্ন হতে “গুড় নামে সিংড়া, একান্ন বিঘা,যোগেন্দ্রনগর ও কালাকান্দরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রীমোহনায় নন্দকুজার সাথে মিশেছে। এদের মিলিত স্রোত গুমানী নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে বড়াল নদীর সাথে মিশেছে। ১৭৮৭ সালে তিস্তার সাথে আত্রাই নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। জলপাইগুড়ির উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ নিমগাছী তাড়াশ, চাটমোহরের হান্ডিয়াল হয়ে অষ্টমনিষার কাছে বড়াল নদীতে মিশেছে। ১৩০৪ সালে ভূমিকম্পে নদীটির কয়েক যায়গা মরে যায়। করতোয়ার নিম্নাংশ আত্রাই ও ফুলঝোড় নামে পরিচিত।
বড়াল নদী পদ্মার চারঘাট মোহনা থেকে নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম হয়ে চাটমোহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে গুমানীর সাথে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর বাঘাবাড়ি হয়ে হুরাসাগরের সাথে মিশে নাকালিয়া এলাকায় গিয়ে যমুনার সাথে মিশেছে। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বীতীয়ার্ধের মাঝামাঝিও নদীটি স্রোতস্বীনি থাকলেও একেবারে শেষের দিকে রাজশাহী থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদীটির অনেক স্থানে ক্রস বাধ দেয়া হয়। মাছ চাষের নামে নদীটি লীজ দেওয়া হতো। লীজ গ্রহীতারা নদীকে খন্ড খন্ড করে ভাগ করে মাছ চাষ করতো। পরে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে নদীটি আর লীজ দেওয়া হবেনা। অনেক দিন যাবত লীজ দেওয়া বন্ধ থাকলেও আবার এ নদীটি লীজ দেওয়ার পায়তারা চলছে। বড়াল নদী উদ্ধারে বড়াল রক্ষা কমিটি দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন সংগ্রাম করে আসার ফলশ্রæতিতে চাটমোহর নতুন বাজার, বোঁথর ঘাট ও রামনগর ঘাটের তিনটি ক্রসবাঁধ অপসারণ করা হয়। উজান অংশে অবৈধ দখলদাররা নদী বন্ধ করে ঘর বাড়ি নির্মাণ করায় এবং উৎসমুখ চারঘাটে পানি না থাকায় এ নদীটি মরে যাচ্ছে। নদীটি মরে যাওয়ায় পদ্মার সাথে যমুনার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে। চাটমোহর থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত বর্ষায় অল্প কিছুদিনের জন্য এ নদীটি প্রাণ ফিরে পায়।
চেঁচুয়া নদী নাটোরের ধারাবারিষার দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাটমোহরের চরসেনগ্রামের পশ্চিমে গুমানী নদীর সাথে মিশেছে। এ নদীটিও প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পরেছে। দক্ষিণ চলনবিলের বড়াইগ্রামের চিনাডাঙ্গা বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাটমোহরের মূলগ্রাম ফৈলজানা হয়ে ফরিদপুরের ডেমরার কাছে চিকনাই নদী বড়াল নদীতে মিশেছে। ডেমরা এলাকায় সুইচগেট থাকায় ফরিদপুর থেকে নদীটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে মাস চারেক এ নদীতে পানি থাকলেও বাকী আট মাস থাকে পানি শূণ্য। এগুলো ছাড়াও বানগঙ্গা, তুলশী নদী, ভাদাই নদীসহ চলনবিলের অন্তত দশ বারোটি নদী এবং প্রায় দুইশত খাল বিল খাড়ি এখন পানি শূন্য।
আত্রাইসহ দু-একটি নদী খনন করা হলেও শুরু থেকেই খনন কাজে অনিয়ম হওয়ায় চলনবিলের মানুষ খুব একটা উপকার পাচ্ছেন না। খননের নামে নদীর মাটি বালি বিক্রির মহোৎসব শুরু হয়েছিল। অনেক স্থানে নদীর মাটি অন্যত্র সড়িয়ে না নিয়ে নদীর মধ্যেই রাখা হয়েছিল।