নানান গুণের অধিকারী ‘ভাষাসৈনিক আবদুল জলিল’

// আজিম উল্যাহ হানিফ
একদম অজপাড়া গায়ের সেই চন্দনা গ্রাম থেকে উঠে আসা তরুন যুবকটি ৫২ এর ভাষাযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম, সুস্থ ধারার ও গণতান্ত্রিক প্রতিটি আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন প্ররোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে। ধাপে ধাপে লেখালেখি, সাংবাদিকতা, পত্রিকা সম্পাদনা, পরিবারের হাল ধরা, নানান পেশায় সম্পৃক্ত থেকে জীবন সংগ্রামে পতিত হয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছেন অনন্য উচ্চতায়। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি আরো ৮/১০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অনেক কষ্ট-সাধনা ও পরতে পরতে করতে হয়েছে বহু সংগ্রাম। বাংলা ভাষার দাবিতে ছাত্রজীবনেই ঝাপিড়ে পড়েন তিনি, এরপর পাকিস্তানের সংবিধান রচনাকে কেন্দ্র করে লেখালেখি শুরু করেন। একক প্রচেষ্টায় কতেক যুবক লেখকদের নিয়ে ১৯৫৮ সালে গড়ে তুলেন ‘লাকসাম লেখক সংঘ’ নামে সংগঠন। সংগঠনটিতে দীর্ঘ ৬১ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ভাষাসৈনিক আবদুল জলিল (১৯৩৬-২০১৯)। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তজাতিক বিভিন্ন বিষয়ে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। বিশেষ করে ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখে লেখক আড্ডায় প্রতিবাদী কবিতা পাঠ করে।তখন লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদের ভিপি ছিলেন সাদেক হোসেন চেয়ারম্যান (১৯৩৭-২০১৭)। আবার একই সময়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক ছিলেন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (১৯৩৪-২০০১)। ৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ গণঅভ্যূথান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর ৭মার্চ ঐতিহাসিক রেসর্কোস ময়দানে বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) ভাষণ শুনতে লাখো জনতার সাথে ভাষাসৈনিক আবদুল জলিলও উপস্থিত ছিলেন। সেদিন অনুষ্ঠানে লাকসামের সাবেক এমএলএ আবদুল আউয়াল সাহেব কোরআন থেকে তেলাওয়াত পাঠ করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের রাখেন অবদান। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধতে ‘লাকসাম লেখক সংঘ’ সংগঠনটির রয়েছে বিশাল অবদান। সদস্যরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দ্রোহের কবিতা পাঠ করে সাধারণ মানুষকে তারা উব্ধুদ্ধ করতেন। কখনো কখনো মুক্তিযোদ্ধাদের নানান কাজে সহযোগিতা করতেন, বিভিন্ন ইনফরমেশন দিয়ে সহযোগিতা করতেন। লাকসাম লেখক সংঘে সম্পৃক্ত থেকে দেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় এই কাজটি করেছিলেন যারা,বিশেষ করে কবি আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম রাহী মিনু, নুরুল হক নেভী, এস এম হেদায়েত, কবি এস এম আবুল বাশার, সানাউল্যাহ নূরী, আবদুল মতিন মজুমদার প্রমুখ । দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে লাকসামে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, দ্বিতীয়টা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালে। এরশাদ সরকার আমলের প্রায় শুরুর দিকে হঠাৎ ভাষাসৈনিক আবদুল জলিলের মনে হয় যে-নিজ উদ্যোগে একটি পত্রিকা প্রকাশনা বের করার। তখন পত্রিকা হিসেবে সারাদেশে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক খবর, দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা বের হচ্ছে। এরপর পরই যায়যায়দিন ও দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা শুরু হয়। কয়েকজন বন্ধুর পরামর্শ ক্রমে নানান নামের মধ্য থেকে লাকসামকে বিশ^ব্যাপী পরিচিত করার মানসিকতা নিয়ে নাম দেন ‘সাপ্তাহিক লাকসাম’। পত্রিকাটি ১৯৮৪ সাল থেকে প্রকাশনা শুরু হয়। পত্রিকাটি বের করতে গিয়ে নানান বাধা বিপত্তি, নানান সমস্যায় পতিত হলেও পত্রিকাটির প্রকাশনা কখনো বন্ধ করেন নি। দেখা গেছে, পত্রিকা বের করতে গিয়ে নানান হিমশিম খেতে হয়েছে, টাকার মিল হতো না প্রায়, ধার দেনা করেও বহু সংখ্যা বের করতে হয়েছে। পত্রিকা বের করার জন্য তথ্য সংগ্রহ, নিউজ তৈরি, নিউজ টাইপিং, পেস্টিং এর পর পত্রিকা বের হওয়ার পর পত্রিকা ভাঁজ করে, ঠিকানা লাগানো, সরকারি ডাক খরচের ডাক টিকিট বসানোসহ পোস্ট অফিসে পৌছানো তৎকালীন সময়ে একক হাতেও পরবর্তীতে ২/৪জনের সহযোগিতায় সহজলভ্য ছিল না। তারপরও এভাবে প্রকাশনার কাজ দিনের পর দিন অব্যাহত রেখেছেন। ২০০০ পরবর্তী ছেলেরা বড় হয়ে মানসিক সার্পোট দিলে পত্রিকার পরবর্তী হাল ধরার নেতৃত্ব সৃস্টি হয়ে যায়। এটি ভেবে প্রায় সময় তিনি তৃপ্তি পেতেন। তাইতো ওনার মৃত্যুর ৫ বছর পরও পত্রিকাটি নিয়মিত বের হচ্ছে ও পাঠকের কাছে পৌছে যাচ্ছে। কামরুদ্দিন সুজন ও সাংবাদিক নুর উদ্দিন জালাল আজাদ তার যোগ্য উত্তরসূরি। লেখালেখি করে জীবনে কিছু না পেলেও প্রায় ১৫টির অধিক একক গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ। যৌথ গ্রন্থ রয়েছে দীর্ঘ ৭০ বছরে প্রায় ৫ শতাধিক। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকা ছাড়াও জেলা ভিত্তিক পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লেখা পাঠাতেন চিঠিপত্র ডাকযোগে হাতে লিখে। পত্রিকা প্রকাশিত হলে আসতো ডাক যোগে। এইরকম শত শত পত্রিকা এখনো সংরক্ষিত রয়েছে লাকসামের ‘অর্নিবাণ’ সাপ্তাহিক লাকসাম পত্রিকা অফিসেও বাসার আলামারীতে। উত্তরদা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সাংসারিক জীবনে পত্রিকা, লেখালেখি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গণে সময় দিতে গিয়ে খুব একটা সময় না দিলেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তার প্রতি ছিল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। যতদিন জীবিত ছিলেন দেশের নানান প্রান্ত থেকে ভক্তরা,লেখক-সাংবাদিকরা ছুটে গিয়ে লাকসামের বাসায় দেখা করতেন। হাসিমূখে কথা বলতেন তিনি। আপ্যায়নেও দেখাতেন আন্তরিকতা। বিভিন্ন দাবী আদায়ও নানান সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে সামনে থেকে। স্ত্রীর বিয়োগের পর ভেঙ্গে পড়েন মানসিক ভাবে। গড়ে তুলেন জলিল-নুরজাহান ফাউন্ডেশন। সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ্উপকরণ দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লেখালেখি করেছেন, মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। ভাষাযুদ্ধের স্বীকৃতি দেরিতে পেলেও মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি তিনি পাননি। আফসোসও করেননি। কারো কাছে বলেন নি কখনো। কোন লেখাতেও বিষয়টি উঠে আসেনি কখনো। তবে ‘লাকসাম লেখক সংঘ’ ও ‘সাপ্তাহিক লাকসাম’ পত্রিকা লেখক ও পাঠক তৈরিতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে যুগে যুগে বৃহত্তর লাকসাম তথা গোটা বাংলাদেশে। নতুন নতুন লেখকদের লেখা ঘষামাজা সম্পাদনা করে প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। বহু সাংবাদিক ও লেখক তৈরির পটভূমি ‘লাকসাম লেখক সংঘ’ ও ‘সাপ্তাহিক লাকসাম’। আজকের দিনে এসে কুমিল্লা,ঢাকা ও বৃহত্তর লাকসামে সাংবাদিকতা করতেছেন, এমন বহু সাংবাদিক রয়েছেন, যাদের হাতে খড়ি ঘটেছে সাপ্তাহিক লাকসাম পত্রিকা ও ভাষাসৈনিক আবদুল জলিল স্যারের হাতে। এই ক্ষণজন্মা মানুষটি আমার এই বিশ্লেষণ মূলক লেখাটি দেখে যেতে পারলেন না, দেখলে হয়তো অনেক খুশি হতেন। কেননা ‘লাকসাম লেখক সংঘ ১৯৫৮ থেকে বর্তমান’, ‘সাপ্তাহিক লাকসাম ১৯৮৪ থেকে বর্তমান’, ‘ভাষাসৈনিক আবদুল জলিল (১৯৩৬-২০১৯)’ অবদান বৃহত্তর লাকসাম তথা পুরো বাংলাদেশে কম নয়। এমন মানুষটি হয়তো জীবনে তেমন সম্মাণ নিয়ে যেতেন পারেন নি হয়তোবা, তবে এই বাংলাদেশের মানুষ এমন মানুষটির কদর হয়তো করবে, তবে সেই দিনটি বেশি দূরে নয়। আল্লাহ ওনাকে জান্নাত নসীব দান করুন, আমিন। ওনাকে কাছ থেকে দেখেছি। দীর্ঘ ১২ বছর কাছ থেকে দেখার, মেশার সুযোগ হয়েছে। তিনি সময় দিয়েছেন এশিয়া ছিন্নমূল মানবাধিকার সংগঠন, কুমিল্লা কবি ফোরামে, জাতীয় কবিতা মঞ্চ, সাংবাদিক শামছুল করিম দুলাল স্মৃতি সংসদে। ছিলেন দক্ষ একজন সংগঠক, সংগঠন তিনি বুঝতেন। লাকসাম প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ছিলেন পল্লী চিকিৎসক। তিনি একাধারে কবি,লেখক, গবেষক, চিন্তাবিদ, গল্পকার, নাট্যকার, উপন্যাসিক, ছড়াকার, কলামিস্ট, ইতিহাসবিদ, নজরুল গবেষক, নবাব ফয়জুন্নেছা গবেষক ছিলেন। ‘লাকসাম জনপদ কথামালা’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে তুমুল আলোচনায় চলে আসেন তিনি। ‘বৃহত্তর কুমিল্লা জনপদের সাংবাদিকতার উদ্ভবও বিকাশের ইতিহাস’ নামেও একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। এই গ্রন্থ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বছরের পর বছর ধরে তথ্য উপাত্ত, ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে সময় ব্যয় করেছেন। সম-সাময়িক বন্ধু হিসেবে পেয়েছেন- কবি আল মাহমুদ, আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিন, কবি সানাউল্যাহ নূরী, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, কবি এস এম আবুল বাশার, আনিসুজ্জামান, এমাজ উদ্দিন আহমেদ, হাসান হাফিজুর রহমান,ভিপি সাদেক হোসেন চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ, আবদুল মালেক মজুমদার, সচিব আবদুল করিম মজুমদার, অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার, অধ্যক্ষ আবদুল মান্নান, এডভোকেট আহমেদ আলী, জয়নাল আবেদীন ভূইয়া এমপি, ওমর আহমেদ মজুমদার এমপি, কবি বেলাল চৌধুরী, এস এম হেদায়েত, কবি আসাদ চৌধুরী, তিতাশ চৌধুরী, ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক, আবুল আসাদ প্রমুখ।