// সঞ্জু রায়, বগুড়াঃ বগুড়ার সরকারী শাহ সুলতান কলেজের কর্মচারীদের প্রতারণার শিকার হয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি অন্ততঃ ১৫ শিক্ষার্থী যে ঘটনায় ইতিমধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে সারাদেশে। তবে শনিবার আকষ্মিক অভিযানে এই প্রতারণার সাথে জড়িত অভিযুক্ত তিন কর্মচারীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে আটক করেছে র্যাব ও পুলিশ।
আটককৃতরা হলেন, কলেজে মাস্টার রোলে কর্মরত মূল অভিযুক্ত হারুনুর রশিদ, অফিস সহায়ক আমিনুর রহমান ও আব্দুল হান্নান। এর মধ্যে হারুনুর রশিদ আর আমিনুর রহমানকে র্যাব ও হান্নানকে পুলিশ আটক করে।
এর আগে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণার অভিযোগের তদন্ত করতে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের সচিব হুমায়ন কবিরের নেতৃত্বে চার সদস্যর প্রতিনিধি দল কলেজে আসেন। শনিবার দুপুর থেকে তারা কলেজে উপস্থিত ভুক্তভোগী চার শিক্ষার্থী রাশেদুল হক, মিলন হাসান, উম্মে হাবীবা ও শারমিন আক্তারের সাথে কথা বলেন। এই সময় তাদের থেকে আলাদা আলাদা লিখিত জবানবন্দি নেওয়া হয়। পরে কলেজের অভিযুক্ত কর্মচারী হারুন ও হান্নানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এই সময় জড়িত হিসেবে আমিনুরের নামও উঠে আসে। পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তদন্ত কমিটির সামনে থেকেই র্যাব ও পুলিশ তাদের আটক করে নিয়ে যায়।
ভুক্তভোগীরা জানায়, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে অনলাইনে আবেদন করে কোনো কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়নি তারা। এই সুযোগে তাদের সরকারি শাহ সুলতান কলেজে ভর্তি করানোর প্রলোভন দেখিয়ে টাকা নেন কলেজের দুই অফিস সহায়ক হারুন ও হান্নান। টাকা দেওয়ার পর তাদের প্রত্যেককেই কলেজ প্যাডে দেওয়া হয় ভর্তির রসিদ। এর পর গত দুই বছরে কলেজে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে তারা। হারুনের কাছে শিক্ষার্থীরা পরিশোধ করেছে বেতন ও পরীক্ষার ফি। এমনকি এইচএসসির ফরম পূরণ বাবদ তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে হারুন ৫ হাজার টাকা করেও নেন। এর মধ্যে পরীক্ষা ঘনিয়ে আসার পরও প্রবেশপত্র না পাওয়ায় এই ১৫ শিক্ষার্থী কলেজ অফিসে খোঁজখবর করতে শুরু করে। হারুনের কাছে প্রবেশপত্র বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি শুরু করেন টালবাহানা। পরীক্ষার আগেই প্রবেশপত্র দেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার পরীক্ষা শুরুর আগে ১৫ শিক্ষার্থী কলেজের অফিস রেজিস্টার পরীক্ষা করে জানতে পারে, তাদের ভর্তি প্রক্রিয়াটাই ছিল ভুয়া।
এদিকে আটকের আগে অভিযুক্ত হারুনুর রশিদের সাথে কথা বললে তিনি জানান, সবকিছু অপরাধ করেছি। এরসাথে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের বিভিন্ন শাখার কয়েকজন জড়িত আছেন। উনারাই বলেছিনে শিক্ষার্থীদের এই প্রক্রিয়ায় ভর্তি করানো সম্ভব। টাকা আমি একা খায়নি। তদন্ত হচ্ছে পরে তিনি সব বলতেও চেয়েছেন। আর হারুনের এমন বক্তব্যের পরই বোঝা চাই এই প্রতারনা চক্রে শুধু হারুন নয় জড়িত রয়েছে কলেজ প্রশাসনের একাধিক ব্যক্তিবর্গসহ শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরও।
তদন্ত কমিটির সাথে সাক্ষাত শেষে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রাশেদুল হক বলেন, তাদের সব অভিযোগ শিক্ষাবোর্ডের তদন্ত টিম শুনেছেন এবং তারা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। আর শিক্ষার্থীরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ চেয়েছেন।
আর নেক্কারজনক এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজীব সাহা, সাধারণ সম্পাদক আল মাহিদুল ইসলাম জয়, সংশ্লিস্ট কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি আতিক রহমান ও সম্পাদক আব্দুর রাব্বি স্বাধীন তাদের পৃথক বক্তব্যে প্রতারণার শিকার শিক্ষার্থীদের যেন ভবিষ্যৎ নষ্ট না হয় সেই লক্ষ্যে তাদের যেকোন উপায়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করার আহŸান জানান। তারা বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কখনোই এমন ঘৃণ্য অপরাধকে প্রশয় দেয়নি আর কখনো দেবেও না। তাই আজ শুধু শাহ সুলতান কলেজই নয় সারাদেশে অফিস সহকারীদের এমন চক্র কোথাও থাকলে তাদেরকে কঠোর হুশিয়ারি দেন ছাত্রনেতারা।
তদন্ত কমিটির কার্যক্রম শেষে সরকারি শাহ সুলতান কলেজের কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক রেজাউন নবীর সাথে কথা বললে তিনি জানান, ইতোমধ্যে কলেজেরও আলাদা তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল জলিলকে। অন্য দুই সদস্য হলেন, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম ও দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল করিম। তাদেরকে তিন কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার সাথে যারা জড়িতে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
আর রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের তদন্ত কমিটির প্রধান বোর্ড সচিব হুমায়ুন কবির বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের পক্ষ থেকে ৪ সদস্যের কমিটি নিয়ে তারা এই তদন্তে এসেছেন। তদন্ত চলছে যা আগামী ২১ তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। ভর্তি জালিয়াতির ঘটনায় বোর্ডের বিভিন্ন শাখার স্টাফ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ রক্ষায় তারা আন্তরিক। শিক্ষামন্ত্রীকে সার্বিক বিষয় অবগত করে তাদের জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আর কর্মচারীদের আটকের বিষয়ে র্যাব-১২ বগুড়ার স্কোয়াড কমান্ডার ( সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার) নজরুল ইসলাম বলেন, ছায়া তদন্তে তারা প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে র্যাবের পক্ষ থেকে তারা মূল অভিযুক্ত হারুন ও আরেকজন আমিনুরকে তারা আটক করেছে। অপর আরেক অভিযুক্তকে আটক করেছে শাজাহানপুর থানা পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং এ ঘটনায় সাথে যারা যারা জড়িত সকলের বিরুদ্ধেই র্যাবের পক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন এই কর্মকর্তা।