ফেলে আসা দিন গুলো-৪১

//এবাদত আলী//

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশের অভ্যণÍরে প্রবেশের সময় মুক্তি ফৌজের এই দলকে ৬ দাঁড় সম্বলিত একটি কাঠের নৌকা দেওয়া হয়। আমাদের এই নৌকা পাবনা সদর থানার বাঙ্গড় নদী দিয়ে ভাটির দিকে দ্রুত চলতে শুরু করলো। মনোহরপুর বড়ো শাকোর নিচ দিয়ে কাশিনাথপুর হয়ে আমরা একসময় আটঘরিয়া থানার কয়রাবাড়ি গ্রামের তারন প্রামানিকের বাড়ি গিয়ে উঠলাম। তারন প্রামানিক আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত সমর্থক। তিনি এবং তার ছেলেরা আমাদেরকে তাদের কাচারি ঘরে বসতে দিলেন এবং এক ধামা মুড়ি ও এক ডিস আখের গুড় নিয়ে এলেন। আমরা কিছু খেলাম এবং সঙ্গে নিয়ে নিলাম। এরপর আমাদের গন্তব্য ফরিদপুর থানার হাদল ইউনিয়নের বাঐখোলার রিকাত মেম্বর বা রিকাত বাবুর বাড়ি।
এই বাড়ির অস্থায়ী ক্যাম্প হতে বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালানো হতে থাকে। পাবনার ফরিদপুর থানায় যারা পিস কমিটি ও রাজাকার আল-বদরের সদস্য ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাদল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও হাদল গ্রামের বাসিন্দা লফরা চেয়ারম্যান। এই লফরা চেয়ারম্যান ছিলেন ফরিদপুর থানা পিস কমিটির চেয়ারম্যান। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ঈশ্বর্দীর ওয়াছেফ আলীর নেতৃত্বে আমাদের সহযোদ্ধা আটঘরিয়ার লক্ষনপুর গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম রফিক ( মোটর শ্রমিক নেতা), সদর থানার রাধানগর ময়দানপাড়ার আব্দুল হামিদ, ঈশ্বর্দীর জয়নাল আবেদীন, নায়েব আলী, ইউনুছ আলী, তোরাব আলী, হায়দার আলী, আব্দুর রশিদ, আব্দুল মালেক, মনসুর আলী, আব্দুর রাজ্জাক, নুরমোহাম্মদ, মোহসিন আলী, রাহাত ও আব্দুস সাত্তারসহ ২০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল ছয় দাঁড়ের নৌকা নিয়ে বাঐখোলার রিকাত মেম্বরের বাড়িতে উঠি। সেখান থেকে আমরা রাতের বেলা উক্ত লফরা চেয়ারম্যনের বাড়িতে অভিযান চালাই।
এলাকার মধ্যে অতি ধনাঢ্য ব্যক্তি এই লফরা চেয়ারম্যান। তিনি লেখা পড়া কম জানলেও নিজ বুদ্ধি ও প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে ফরিদপুর থানার হাদল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফরিদপুর থানার পিস কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আমরা তার বাড়ির সদর দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করি এবং তাকে খুজতে গিয়ে দেখা যায় তিনি তার মাটির দোতালা ঘরের মধ্যে জায়নামাজে চুপচাপ বসে আছেন। কয়েকজন যোদ্ধা তাকে চ্যাংদোলা করে নামিয়ে উঠানে নিয়ে আসে। কমান্ডার টুআইসি জয়নালকে নাম ধরে ডাক দেওয়ায় চেয়ারম্যানের স্ত্রী ছুটে এসে জয়নালের পায়ের উপর উপুর হয়ে পড়ে তাকে বলে বাবা তুমি আমার জামাই। আমার জামাইয়ের নাম জয়নাল। আজ থেকে তুমি আমার বেটা। ও বেটা তোমাদের পায়ে ধরি আমার স্বামীকে তোমরা মেরনা।
অপর দিকে আরেকটি কান্ড ঘটে গেল চেয়ারম্যানের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক আমাকে চিনতে পারে। কারণ পাবনা আরএম একাডেমীতে লেখা পড়া করার সময় ১৯৬৭ সালে আমার সম্পাদনায় প্রথম আর এম অ্যাকাডেমী বার্ষিকী বের হয়। রাজ্জাকও তখন আর এম একাডেমীর ছাত্র। সে আমার এক ক্লাশ নিচে পড়তো। তারই সুত্র ধরে সেও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো তার আব্বার জীবন ভিক্ষা চাইতে লাগলো সেই সঙ্গে সে আর এম অ্যাকাডেমীর বার্ষিকীটিও এনে আমার হাতে দিলো।
কমান্ডার এসব দৃশ্য দেখে অবাক হযে যায়। এসময় উক্ত চেয়ারম্যান জীবন রক্ষার জন্য স্বপ্রনোদিত হয়ে একটি কোরআন শরীফ আনতে বলে। তা আনা হলে তিনি কোরআন শরীফ ছুয়ে শপথ করে, পিস কমিটির চেয়ারম্যানের পদ হতে তাৎক্ষণিক পদত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীকে সাহয্য সহযোগীতা করার অঙ্গিকার করেন। সেদিনের পর হতে তার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপিত হয়। সেসময় যেসকল মুক্তিযোদ্ধা নৌপথে ঐ এলাকা দিয়ে যাতায়াত করতেন তাঁরা তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিতেন এবং অস্থায়ী ক্যাম্প হিসাবে সেখানে অবস্থান করতেন। এতে করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও পিস কমিটির লোকেরা তার উপর ক্ষিপ্ত হলেও মুক্তিযোদ্ধাগণ তাকে জীবন বাঁচাতে সহায়তা করে। দেশ স্বাধীনের পরে উক্ত লফরা চেয়ারম্যান মৃত্যুবরণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হাদল সিনিয়র মাদ্রাসার শিক্ষক জনৈক মওলানা ছিলেন ফরিদপুর থানার পিস কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি সেই সময়ে হত্যা, লুন্ঠন, নারী ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন। আমরা তার বাড়িতেও অভিযান চালাই কিন্তু তার আগেই তিনি বাড়ি হতে পালিয়ে যান। বর্তমানে সে এলাকায় তিনি একজন সুফি মোত্তাকিন হিসাবে পরিচিত। পিস কমিটির আরেকজন সদস্য আটঘরিয়ার লতিফ মওলানা। সেখানেও অপারেশন চালানো হয়।
পাবনার চাটমোহর থানার ফৈলজানা গ্রামের বিহারি নাথু পাটনী, আটঘরিয়া থানার পিস কমিটির দালাল মৌলভী আব্দুল লতিফ ওরফে লতিফ মওলানা, থানার রাজাকার কমান্ডার মোমিন, রাজাকার মজিবর রহমান ঠান্ডু, আবু তালেব রাজাকার প্রমুখ ব্যক্তি এবং নাথু পাটনীর পাবনা শহরের সহযোগীগণ সম্বিলিতভাবে আটঘরিয়া থানার গোড়রী গ্রামের হিন্দুদের উপর পাকিস্তানি আর্মিদের দ্বারা অকথ্য নির্যাতন চালায়। গোড়রী গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রাম। এই গ্রামের অধিকাংশ হিন্দুই ছিলেন অবস্থাপন্ন। তাই এই গোড়রী হিন্দু পাড়ায় অপারেশনের জন্য তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে।
পাকিস্তানি হায়েনার দল ঘটনার দিন রাজাকার ও পিস কমিটির দালালদের সঙ্গে করে এই গোড়রী গ্রামে হামলা চালায়। অতর্কিত হামলায় গ্রামবাসী দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের স্ত্রী, পুত্র, পরিজনসহ দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড়ে পার্শ্ববর্তী গ্রাম তারাপাশায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। কেউবা প্রাণ বাঁচাতে রতœাই নদী সাঁতরিয়ে ফৈলজানা ও ইদিলপুর কুয়াবাসি গ্রামের দিকে চলে যায়। হায়েনার দল সামনে যাকে পায় তাকেই গুলি করতে থাকে। এ হামলায় কতজনের প্রাণহানি ঘটেছিল তা নিশ্চয় করে না জানা গেলেও তারা ঐ গ্রামে অবাধে লুটতরাজ চালায়।
এই খবর পাবার পর আমাদের এই মুক্তিযোদ্ধার দলটি নাথু পাটনীর বাড়িতে অপারেশনের জন্য গোড়রী ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হয়। এদিন নাথু পাটনীর বাড়িতে এলাকার দালাল ও রাজাকারদের এক ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল। পাশ্ববর্তী একটি গ্রাম থেকে একটি খাসি ধরে এনে জবাই করে ধানের আটার রুটি তৈরি করে তারা বেশ মজা করে খাবারের আয়োজন করে। (চলবে…) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট