// সঞ্জু রায়ঃ রং বেরঙের ঘুঁড়ির পশরা আর লোকজ নানা সংস্কৃতিতে সজ্জিত হয়ে বগুড়ায় শুরু হয়েছে ৭দিন ব্যাপী ঐতিহ্যবাহী দাঁড়িয়াল মেলা। বগুড়া শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে নুনগোলা ইউনিয়নের দাঁড়িয়াল গ্রামে অনুষ্ঠিত শত বছরের প্রাচীন এই মেলাটি এলাকায় পরিচিত নিশান মেলা বা ঘুঁড়ির মেলা হিসেবেও। মেলাকে ঘিরে উৎসবের আমেজ পরেছে আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষের মাঝে।
বিমান ঘুঁড়ি, ফসকে ঘুঁড়ি, কয়েক রকমের চং কিংবা গ্রাম্য ভাষায় হরেক রকমের গুড্ডি যার পশরা সাজিয়ে ব্যবসায়ীরা বসেছে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী দাঁড়িয়াল মেলায়। ঘুঁড়িগুলোর ক্রেতা ছোট বড় সকল বয়সের মানুষ যেন ঘুঁড়ির মাধ্যমে সকলে মেতে উঠেছে আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় আর জীবন্ত করে তোলার চেষ্টা করছে নিজেদের শৈশবের স্মৃতি।
মেলায় ঘুঁড়ি কিনতে আসা শিবগঞ্জের বাবর মিয়া বলেন, আগে ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে কয়েক মাইল হেঁটে এমেলায় আসতাম আর এখন নিজে সন্তানকে সাথে নিয়ে এসেছেন। সময়ের পরিবর্তনে সবকিছু বদলালেও বদলায়নি ঘুঁড়ির প্রতি নেশা তাইতো এসেই ৩’শ টাকা দিয়ে কিনেছেন ৩টি নানা ডিজাইনের ঘুঁড়ি।
মেলাতে এবার প্রায় দশ রকমের ঘুড়ি পাওয়া যাচ্ছে যার দাম আকার ভেদে ৬০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। আর ঘুড়ি উড়ানোর নাটাই ও সুতা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে। তবে তীব্র রোদের মাঝেও ক্রেতাসমাগমের ভীড় থাকলেও আশানুরুপ ঘুঁড়ি বিক্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
ঘুঁড়ি ব্যবসায়ীদের একজন মজনু মিয়া বলেন, গত বছরের থেকে এবছর মেলায় ভীড় বেশি কিন্তু দুর্ভাগ্য বাতাস না থাকায় ক্রেতাদের ঘুড়ি উড়িয়ে দেখাতে পারছেন না তারা তাই বেচাকেনাতে কিছুটা ভাটা পরেছে। এছাড়াও জিনিসপত্রের উর্ধ্বমুখী দামে বাড়াতে হয়েছে ঘুঁড়ির দামও তাই বেশি দামে অনেকেই ঘুঁড়ি কিনতে চাইছেন না।
তবে আকাশে উড্ডয়মান এই ঘুঁড়ির পাখা মেলে উড়া দেখতে দেখতেই যেন শৈশবের স্মৃতিকে খুঁজে বেরাচ্ছে মেলায় আগত দর্শনার্থীরা তাইতো দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে ছুটে এসেছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। আর মেলায় শিশুদের নির্মল আনন্দ ছিলো চোখে পড়ার মতো।
ঘুড়ির পরেই মেলায় নজর কেড়েছে বাহারি মিষ্টির দোকানগুলো। রস কদম, কুলফি, কালো জাম, পাতা মিষ্টি, ছানা জিলাপি, রসগোল্লা, মৌচাক, লাল কদম, পোটল, হাসি-খুশি, কাটারি ভোগ ও বড় মাছসহ মেলায় শোভা পাচ্ছে প্রায় ১৫ পদের মিষ্টি যার বেচাবিক্রিও বেশ ভালো।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, দাঁড়িয়াল গ্রামের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ঈদে শ্বশুরবাড়ি না আসলেও হবে তবে এই মেলায় না আসলে নিস্তার নেই জামাইদের। তাইতো জামাই আপ্যায়নে গ্রীষ্মের পাকা কাঠাল, লিচু, আম, তরমুজ, জাম, তালের শাস সবই আছে এ মেলায়। ফল ও মিষ্টি ছাড়াও এই মেলাটিতে প্রতিবছর জমজমাট হয় কাঠের আসবাবপত্র বিক্রিকে ঘিরেও। মেলায় খাট, শোকেজ, ড্রেসিং টেবিল, দরজা-জানালা, টেবিল ও চেয়ারসহ কাঠের তৈরি সবরকম আসবাবপত্রের পসরাও বসেছে আর ক্রেতাসমাগমও গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক ভালো।
এছাড়াও মেলায় ছোটদের জন্যে সারি সারি খেলনার দোকান বসার পাশাপাশি সকল বয়সী মানুষের বিনোদনে রয়েছে নাগরদোলা, সার্কাস, মোটরসাইকেল স্টান্ট শো, জাদু খেলাসহ নানা আয়োজন। তবে সার্কাস ও জাদুখেলার আড়ালে অশ্লীল নৃত্য অনেকটাই ম্লান করেছে এই লোকজ মেলার গৌরবকে। আর দিনের আলোকে ছাপিয়ে মেলার চারিদিক দিয়ে জমজমাট জুয়ার আসরও বসার অভিযোগ এলাকাবাসীর যাতে সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে লোকজ এই মেলা।
যদিও মেলার নামে কোন অশ্লীলতার সুযোগ নেই আর সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধানে তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন বলে জানান বগুড়া সদর থানার অফিসার ইনচার্জ নূরে আলম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, রবিবার মেলার মূল আয়োজনের দিন সার্কাস ও জাদুর নামে অশ্লীল নৃত্যের খবর তারা পাওয়ার সাথে সাথেই তা বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় কোনরকম অশ্লীলতাকে তারা সহ্য করবেন না। ওসি নূরে আলম আরো বলেন, লোকজ এই মেলাগুলোর মাধ্যমে এখনো টিকে আছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। তাই লোকজ এই আয়োজনে বিশৃঙ্খলার কোন সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষ নির্মল আনন্দ লাভ করবে এমনটাই কাম্য যা নিশ্চিতে পুলিশ মাঠে রয়েছে।
জনশ্রুতি আছে বহু বছর আগে এই এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বাঁশের মাথায় লাল গামছা ও মাথার চুল উত্তোলন করে নিশান উড়িয়ে উৎসব পালন করতেন। সেই থেকে এই মেলা প্রথমে নিশান ও পরবর্তীতে এলাকার নাম অনুসারে দাঁড়িয়াল মেলা হিসেবে নামকরণ হয়। দাঁড়িয়াল মেলার মতো এমন হাজারো লোকজ মেলার মাধ্যমে এখনো টিকে আছে আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। তাইতো যুগের পর যুগ সকল নেতিবাচক সত্ত্বাকে দূরে ঠেলে নিজেদের শেকড়ের টানে নিজ সংস্কৃতিকে এভাবেই আগলে রাখার প্রত্যাশা এই অঞ্চলের মানুষের।