আমার স্মৃতির পাতায় আরএম অ্যাকাডেমি

// এবাদত আলী //
পাবনা শহরের ইছামতি নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে আর এম অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠান। যার নাম রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমি বা আর এম অ্যাকাডেমি। এই প্রতিষ্ঠানটির গোড়াপত্তনকারি রাধানগর মহল্লার দ্বারকানাথ মজুমদার। তিনি ১৮৯৯ সালে এই আরএম অ্যাকাডেমির গোড়াপত্তনের জন্য জমি দান করেন। পাবনা এডয়ার্ড কলেজ মাঠ লাগোয়া মনোরম পরিবেশে এই প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত।
১৯৬১ সালে আমি এই রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমি অর্থাৎ আর এম অ্যাকাডেমিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। হাতে বহরে একটু লম্বা ছিলাম বলে আমাকে এ সেকশনে ভর্তি করা করা হলো।
আমাদের হেড মাষ্টার ছিলেন তাজ উদ্দিন আহমেদ, বিএ বিএড।
অজ পাড়া গাঁয়ের ছেলে আমি। শহরের সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি তাই শহুরে ছেলেদের সাথে আমি মিশতে দারুন ভয় পেতাম। দোপ এলাকায় যাদের বাড়ি তাদেরকে বেশি করে খুঁজতাম। পেয়ে গেলাম আটঘরিয়া থানার বেরুয়ান গ্রামের অ্যাডভোকেট শাহাদত মোল্লার (গভঃ প্রাইমারি স্কুলের হেড মাষ্টার) এর ছেলে এএসএম নজরুল ইসলাম রবি (পরে মেজর জেনারেল (অবঃ) ও ডিজি এফ আই এর সাবেক ডিজি)র খোঁজ। সে বি সেকশনে পড়তো। একই গ্রামের ঠান্ডু। আরো খোঁজ পেলাম হাপানিয়ার ইউছুফ আলী বাঘা, গাছপাড়ার নুরুল ইসলাম নুরু (বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পাবনা সদর থানার প্রথম থানা কমান্ডার), বালিয়াহালটের ওয়াহাব (পরে ইঞ্জিনিয়ার) মনোহরপুর গ্রামের আকুব্বার, ইসমত, মালিগাছার সুলতান আহমেদ চাঁদু, ফরিদপুর থানার হাদল গ্রামের অশোক কুমার রায় এবং একদন্তের অগাষ্টিন সরাও এর।
কিছুদিন পর পাবনা শহরের মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার) আবুল মাসুদ লাল (সাবেক সম্পাদক পাবনা বনমালি শিল্পকলা) মকবুল হোসেন সন্টু (সাবেক এমপি বর্তমানে মৃত), ফেরদৌস হালিম খান চিনু (লন্ডন প্রবাসী), শ্যামল দত্ত (ভারতের মুর্শিদাবাদ হাসপাতালের ডাক্তার), জাহিদ হাসান জিন্দান (সাবেক প্রধান শিক্ষক টেবুনিয়া ওয়াছিম পাঠশালা, মৃত), আব্দুল ওয়াহাব (ইঞ্জিনিয়ার), মুক্তার হোসেন, সিদ্দিক, রফিকুল, খোকন, রাধানগরের হাবিবুর, আমিনুল ইসলাম মুক্তা, পাবনা টাউন সুবেদারের ছেলে জালাল উদ্দিন, পৈলানপুরের মিরজাউল হোসেন তারা, ঈশ্বরদী দাদপুরের তোজাম্মেল হক (স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ) ও সাইদুর রহমানসহ আরো অনেকের।
আরএম একাডেমীতে ভর্তি হবার আগে আমি বাঙ্গাবাড়িয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করতাম। তাই শুদ্ধভাবে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে পারতাম। স্কুলে প্রতিদিন যে এসেম্বলি হতো তাতে রুহুল আমিন ভাই(পরে এসপি) কোরআন তেলাওয়াত করতেন। নজরুল একদিন হেড স্যারকে আমার তেলাওয়াতের কথা বলে দেয়। এসেম্বলি শুরুর আগে আমার ডাক পড়ে। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। আমার বুক দুরু দুরু করে কাঁপতে থাকে। সুরা বাকারার ফাজকুরুনি আজ কুরুকুম ওয়াশকুরুলি ওয়ালা তাক ফুরুন এই আয়াত তেলাওয়াত করলাম। কেমন তেলাওয়াত তা বুঝলাম যখন হেড মাস্টার ডেকে বল্লেন এখন থেকে তুমিই তেলাওয়াত করবে আর রুহুল আমিন জাতীয় সঙ্গীত গাইবে। এতে করে আমার ক্লাসে উপস্থিতি ঠিক সময় মত হতে হতো। এছাড়া কোন উপায় ছিলোন। রুহুল আমিন ভাই এবং আমি এদুজনই ছিলাম একে অপরের পরিপুরক। যেদিন তিনি কোরআন তেলাওয়াত করতেন সেদিন আমি জাতীয় সঙ্গীত গাইতাম। জাতীয় সঙ্গীত ছিলো নি¤œরুপঃ
পাকসার জমিন সাদ বাদ/ কিসওঅরে হাসিন শাদবাদ…………
পায়েন্দাতা জিন্দাবাদ, ………………
শাদ বাদ মনজিলে মুরাদ। ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর এম একাডেমীতে অধ্যয়ন কালে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় একবার আমার সহপাঠি নজরুল ইসলামের বুদ্ধিতে নজরুল, নুরুল, দাউদ, তজিম সকলে মিলে যেমন খুশি তেমন সাজোতে গরুর গাড়িতে করে বর ও বরযাত্রি নিয়ে খেলার মাঠে প্রবেশ করা হলো। নাহেরকে বর, তজিমকে বরের পিতা, আমাকে বিবাহ পড়ানো মোল্লা, নুরুলকে কনের পিতা আর আবু দাউদকে ওর ভাবির শাড়ি পরিয়ে কন্যা সাজানো হলো। নজরুলসহ অন্য সকলে বরযাত্রি হয়ে গরুর গাড়িতে চড়ে খেলার মাঠে গিয়ে উপস্থিত।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পাবনার ডিসি মিঃ কেজিএম লতিফুল বারি সিএসপি এবং তাঁর স্ত্রী। প্রধান শিক্ষক এবং শিক্ষক বৃন্দ, অভিভাবক বৃন্দ সকলেই হেসে লুটোপুটি খেলেন। আর ছাত্রদের তো কোন কথাই নেই। সকলেই আমাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যেমন খুশি তেমন সাজোতে কেউ যে সত্যি সত্যি বর ও বরযাত্রি সেজে গরুর গাড়িতে করে খেলার মাঠে প্রবেশ করতে পারে এযেন সকলের কাছেই ছিলো অকল্পনীয়। আমাদেরকে ডিসি সাহেব এবং তার স্ত্রী কাছে ডেকে নিলেন। আমাদের সঙ্গে তারা ছবি উঠলেন। পাবনা শহরের রূপছায়া স্টুডিওর ক্যামেরাম্যান ওয়ান টুইন্টি বক্স ক্যামেরা দিয়ে আমাদের ছবি তুল্লেন। সে এক এলাহি কান্ড। প্রথম পুস্কার তো পেলামই তার উপরে ডিসি সাহেবের স্ত্রী আমাদেরকে বিশেষ পুরস্কারে ভুষিত করলেন।

১৯৬৩ সালের দিকে আর এম একাডেমির কতিপয় ছাত্র প্রধান শিক্ষক তাজ উদ্দিন আহমেদকে মারধর করলে তিনি মনের দুঃখে চাকরি ছেড়ে চলে যান। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন বাহাদুর আলী। এর কিছুদিন পর শাহজাদপুরের পোতাজিয়ার আজিজুল হক প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি দীর্ঘদিন এই বিদ্যালয়র প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
১৯৬৪-৬৫ শিক্ষা বর্ষে পাবনা আরএম একাডেমিতে একটি নাইট কলেজ খোলা হয়। কর্মজীবী মানুষদের লেখাপড়ার বিষয়ে অগ্রণি ভুমিকা পালন করেন অধ্যক্ষ আব্দুল গণি। অধ্যাপক আবু সাঈদসহ এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষকগণ এই কলেজে শিক্ষকতা করতেন। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধে। এই যুদ্ধে পুর্ব-পাকিস্তন থেকে যুবকদেরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে তাই সিভিল ডিফেন্সসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য আহবান জানানো হয়। এই আহবানে সাড়া দিয়ে নিজের মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধে যেতে রাজি হয়ে আমি এবং আমার সহপাঠি নজরুল, নুরুল, তোজাম্মেল, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, নাহের, দাউদসহ অনেকেই নাম লেখাই এবং ট্রেনিংএ অংশগ্রহণ করি।
আমাদেরকে ফাষ্ট এইড ট্রেনিং, ব্লাকআউট, ট্রেঞ্চ খনন, বাংকার খনন, বিমান হামলায় করনিয়, জনগনকে সতর্কিকরণসহ রাইফেল ট্রেনিং পর্যন্ত দেওয়া হতে থাকে। পাবনা সদর হাসপাতালের ডাক্তার, সিভিল ডিফেন্স অফিসার, পুলিশ অফিসার, সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ আমাদেরকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিতেন। এই প্রশিক্ষণ শেষে আমাদেরকে হায়ার ট্রেনিংএর জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। আর সেই ট্রেনিং হবে ক্যান্টনমেন্টে। ভবিষ্যতে এই ট্রেনিংএর মাধ্যমে ইচ্ছা করলে তাদেরকে সেনাবাহিনীতে রিক্রুট করা হবে বলেও জানানো হয়। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হয়না। ট্রেনিং চলাকালিন সময়েই যুদ্ধ থেমে যায়। আমাদেরকে ট্রেনিং কোর্স সম্পাদনের জন্য সার্টিফিকেট প্রদান করা হয় এবং দেশের ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সাহসিকতাপুর্ণ কাজের মূল্যায়ন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এই অনুষ্ঠানে আমাকে অ্যাকাডেমির ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যাকে বলে জিএস। এই অনুষ্ঠানে আরেকটি ঘটনা ঘটে যা আমার সাহিত্য জীবনের সুচনা করে। আর তা হলো আরএম অ্যাকাডেমি থেকে এই প্রথমবারের মত একটি ম্যাগাজিন বা বার্ষিকী বের করা হবে। এজন্য শিক্ষকদের মধ্য হতে ইংরেজির শিক্ষক জহুরুল হককে সম্পাদক নিযুক্ত করা হয় এবং জহুরুল হক স্যারের প্রস্তাবে আমাকে ম্যাগাজিন সেক্রেটারি বা বার্ষিকী সম্পাদক করা হয়।
দেখতে দেখতে ১৯৬৬ সাল এসে গেল। এবছর আমার এসএসসি পরীক্ষা এবং বার্র্ষিকী সম্পাদনার কাজ। দুটোই সমানতালে চলতে থাকে।
এসএসসি পরীক্ষর জন্য একসময় টেস্ট পরীক্ষা দিতে হলো। এরপর ফরম পুরণ করা হলো। যথাসময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো পাবনা জেলা স্কুল কেন্দ্রে। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া মানে জীবনের নতুন অভিজ্ঞতা। সে রোমাঞ্চকর অনুভুতির কথা ব্যক্ত করা খুবই কঠিন। ভালোয় ভালোয় পরীক্ষা হয়ে গেল।
এসময় লম্বা ছুটি। তাই বার্ষিকী বের করার কাজ জোরে শোরে কাজ চলতে থাকে। জহুরুল স্যারের মাধ্যমে পাবনার মডার্ণ আর্ট প্রেসে বার্ষির্কী ছাপাতে দেয়া হলে আমাকে প্রায় প্রতিদিনই প্রুফ দেখতে যেতে হতো। প্রেসের মালিক আবু মিয়া একজন অমায়িক ব্যাক্তি। তিনিও প্রুফ দেখতেন। নামে মডার্ণ আর্ট প্রেস হলেও লেটার প্রিন্ট করা হতো। কাঠের বাক্সে কবুতরের খোপের মত খোপে খোপে শিশার লেটার বা অক্ষর। তার সঙ্গে আকার ওকার দীর্ঘ ঈকার ইত্যাদি বর্ণমালা সাজানো থাকতো। যখন যেটা দরকার কম্পজিটর সেটা নিয়ে মালা গাঁথার মত অক্ষর সাজিয়ে তা ছাপার জন্য মেশিনম্যানের নিকট দেয়া হতো। মেশিনম্যান সাজু তা পায়ে প্যাডেল মেরে ছাপিয়ে দিতেন।
স্কুল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদপট অংকন ও ব্লক নির্মাণ করেছিলেন এম ওয়াজেদ আলী সলভী। প্রকাশনা ও সম্পাদনায় আর এম একাডেমির ছাত্রদের তরফ থেকে মোহাম্মদ জহুরুল হক বিএবিএড ও মোহাম্মদ এবাদত আলী দশম শ্রেণি ক শাখা। আরএম অ্যাকাডেমি বার্ষিকীর প্রকাশ কাল ১৩৭৩-৭৪ সন বাংলা। এর পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আজিজুল হক বিএ বিএড। আলোক
চিত্র গ্রহণে রূপ ছায়া স্টুডিও, পাবনা। মুদ্রণে ও গ্রন্থনে মোহাম্মদ আবুল হোসেন মিয়া, মডার্ণ আর্ট প্রেস, পাবনা
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো। আমি সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে এসএসসি পাশ করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হলাম। আমার স্মৃতির পাতায় আর এম অ্যাকাডেমি আজো জ্বল জ্বল করে ভেসে ওঠে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রাক্তন ছাত্র, আর এম একাডেমী। (১৯৬১-১৯৬৬)