হযরত শাহ জালাল (রঃ)
এর মাজারে কিছুক্ষণ।

// এবাদত আলী।

দিনটি ছিল ২৫ জানুয়ারী ২০০২ শুক্রবার। সিলেট শহরের তালতলা এলাকার একটি মসজিদে জু’মার নামাজ আদায় করে দুপুরের খাবার সেরে হোটেল গুলশানে গিয়ে সামান্য সময় বিশ্রামের পরপরই হয়রত শাহ জালাল (রঃ) এর মাজার শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। 

সিলেট শহরের মনোরথ নামক টিলার উপর অবস্থিত সায়খুল মাশায়েখ হযরত শাহ জালাল (রঃ) এর মাজার। স্থানীয় ভাষায় বলা হয় হযরত শাহ জালালের (রঃ) দরগাহ শরীফ। এই দরগাহ শরীফের প্রবেশ পথে রয়েছে প্রকান্ড গেইট। গেইটটির নাম ইয়ামেনী গেইট। গেইটের পাশে আমাদের বাসটি রেখে যার যার মত মুল মাজার শরীফের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। সিলেট শহরের অধিবাসী আমার সুহৃদ ফেরদৌসার রহমান। ফেরদৌস গাইড হিসাবে আমাদেরকে সাথে নিয়ে চল্লেন।
প্রায় ৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দে এই ইয়ামেনী গেইটটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে তিনি জানালেন। মাজার শরীফের প্রবেশ পথে জিয়ারতকারি এবং দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনার জন্যই গেইটটি নির্মাণ করা হয়েছে। যার উপরে আরবী অক্ষরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ লেখা রয়েছে।
গেইট পেরিয়ে কয়েকশ গজ পশ্চিম দিকে যাবার পর দোতলা ঘরের মত আরেকটি গেইট। এর ভিতর দিয়ে মাজার শরীফের মুল চত্বরে প্রবেশ করতে হয়। এই গেইটের নাম নাক্কারখানা। সিলেটের ইংরেজ কালেক্টর জন উইলিস (১৭৮৭-১৭৯৩ খ্রিঃ) এই নাক্কারখানাটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ভুমিকম্পের ফলে এটি সম্পুর্নরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
এই নাক্কারখানা থেকে হয়রত শাহাজালাল (রঃ) এর মাজার চত্বর শুরু। মাজার ও মাজার সংলগ্ন টিলা এবং সমতল ভুমিসহ প্রায় ১০ একর এলাকা জুড়ে মাজার চত্বর।
সাইখুল মাসায়েখ হয়রত শাহ জালাল (রঃ) সর্ম্পকে যত দুর জানা যায় তিনি দিল্ল¬ীর বাদশাহ আলাউদ্দিন খলজির শাসনামলে ৩৬০ জন মুরীদ বা শিষ্যসহ সিলেট আগমণ করেন এবং সিলেটের তৎকালীন রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে এখানে বসতি স্থাপন করেন। হয়রত শাহ জালাল (রঃ) সর্ম্পকে বিভিন্ন তথ্য ও সুত্র হতে আরো জানা যায় তার পুর্ব পুরুষেরা ছিলেন কোরেশী বংশীয় এবং এশিয়া মাইনরের কুনিয়ার বাসিন্দা। তার পিতার নাম- আমীর মোহাম্মদ বিন কোরেশী এবং মাতার নাম ফাতিমা হাছিনা সাঈদা। তিনি ১২৭১ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ মে তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের মাত্র ৩ মাস পরই তার পিতা-মাতা ইন্তেকাল করেন। তিনি মামার আশ্রয়ে থেকে পবিত্র কোরআন-হাদীস ফেকাহসহ ইসলামের বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন।
শিক্ষা সমাপ্তির পর প্রখ্যাত সুফি সাধক সায়িদ আহম্মদ কবির (রঃ) এর মুরীদ হন এবং তার নিকট হতে এলমে তাসাউফ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী হন। প্রচলিত কাহিনী মতে বলা যায় সিলেটের প্রথম মুসলমান বুরহান উদ্দিন রাজা গৌর গোবিন্দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তিনি শিশু পুত্রের আকিকা উপলক্ষে একটি গরু জবাই করলে রাজা গৌর গোবিন্দ রাগান্বিত হয়ে সেই শিশু পুত্রটিকে হত্যা করে এবং বুরহান উদ্দিনের একটি হাত কেটে দেয়। বুরহান উদ্দিন তখন বাংলার সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের নিকট বিচার প্রার্থনা করলে সুলতান তার সেনাপতি সিকান্দার গাজীকে সিলেট অভিযানে পাঠান। এদিকে বুরহান উদ্দিনের দুঃখ দূর্দশার সংবাদ পেয়ে হয়রত শাহ জালাল (রঃ) তার শিষ্য সৈন্যসহ দিল্ল¬ী হয়ে সিলেট অভিমুখে রওনা হন। অপরদিকে দিল¬ীর সম্রাট আলাউদ্দিন খলজী এ সংবাদ পেয়ে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন (রঃ) কে সেনাবাহিনীসহ সিলেট যাবার ব্যবস্থা করে দেন। সৈয়দ নাসিরুদ্দিন বাংলায় প্রবেশের জন্য রওনা পথে এলাহাবাদে হয়রত শাহ জালাল (রঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। পথিমধ্যে সেনাপতি সিকান্দার গাজীর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হলে তখন তারা যৌথভাবে সিলেটের রাজা গৌর গোবিন্দের বিরূদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। যুদ্ধে রাজা গৌর গোবিন্দের বিপুল সংখ্যক সৈন্য বাহিনী পরাস্থ হয়। ফলে রাজা সিলেট হতে পলায়ন করে।
যাক মুল চত্বর পেরিয়ে আমরা মাজারের দিকে এগুতে লাগলাম। টিলার উপর অবস্থিত মাজারে ওঠার জন্য রয়েছে অনেকগুলো প্রশস্থ সিঁড়ি। সিঁড়ির বাম পাশে চারতলা বিশিষ্ট দরগাহে হয়রত শাহাজালাল (রঃ) এর মসজিদ। ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে মহান এই সাধকের মৃত্যুর পর তার মাজারের পাশে বাংলার সুলতান আব্দুল মোজাফ্ফর ইউসুফ শাহের মন্ত্রী মজলিশে আতার আমলে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটির গোড়া পত্তন করা হয়। মাজারে ওঠার সিঁড়ির ডান পাশে রয়েছে মহিলাদের ইবাদতের জন্য একটি একতলা ইবাদত খানা।
হয়রত শাহ জালাল (রঃ) এর মাজারের দক্ষিন দিকে গ্রিল ঘেরা তারকা খচিত একটি ছোট ঘর চোখে পড়লো। ফেরদৌস জানালেন এটি হয়রত শাহ জালাল (রঃ) এর চিল¬াখানা। এই চিল¬াখানায় হয়রত শাহাজালাল (রঃ) ২৩ বছর ইবাদত করেছেন। চিল¬াখানার উত্তর দিকের প্রবেশ পথ দিয়ে সামান্য এগুতেই হয়রত শাহ জালাল (রঃ) এর মাজার। মাজারটি ইট দিয়ে উঁচু করে বাঁধানো। এই আবেষ্টনী ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ১০৭০ হিজরীতে নির্মিত বলে জানা গেল। মাজারের চারপাশে চারটি স্তম্ভ রয়েছে। এই স্তম্ভগুলোতে একটির উপরে একটি করে চারটি চাদোয়া টাঙানো। মাজারের চারপাশ ঘিরে অগণিত মানুষের ভিড়। খাদেমগণ অনবরত গোলাপ জল ছিটাচ্ছেন মাজারের উপর। বিভিন্ন ধরণের আতোর গুলানো পানিও ছিটানো হচ্ছে। স্তুপাকার আগরবাতির ধুয়ার সাথে, আতোর গুলানো পানি আর তরতাজা গোলাপের পাপড়ির সুগন্ধি বাতাসে ভেসে মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। যা দর্শনার্থীর বা মাজার জিয়ারতকারীগণের হৃদয়ের পরশ ছুঁয়ে ভক্তি আর আবেগে মাতোয়ারা করে তুলছে।
হয়রত শাহ জালাল (রঃ) এর মাজারের দু’পাশে আরও দুটি মাজার রয়েছে। পুর্বদিকের মাজরটি ইয়ামেনী যুবরাজ শাহজাদা আলী (রঃ) এর। হযরত শাহ জালাল (রঃ) এর সংস্পর্শে এসে রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে তার সহযাত্রী হন। পশ্চিম দিকের মাজারটি সিলেটের শাসনকর্তা উজির মকবুল খানের (১৪০০ খ্রিঃ)। আমরা ফাতেহা শরীফ ও দোয়া-দরুদ পাঠ অন্তে মাজার জিয়ারত করলাম।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে সমতল চত্বরে আসতেই চোখে পড়লো বহু সংখ্যক কবুতর। এগুলো জালালী কবুতর নামে পরিচিত। কথিত আছে হযরত শাহ জালাল ভারতবর্ষে পদার্পণ করার পর হযরত নিজামুদ্দিন আওলিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি হযরত শাহ জালাল (রঃ) কে এক জোড়া কবুতর উপহার দেন। বংশ পরিক্রমায় এই কবুতর আজো বিদ্যমান। সিলেট বাসীর প্রচলিত ছড়া “ঝাঁকে উড়ে আকাশ জুড়ে দেখতে কি সুন্দর, বাবার জালালী কৈতর”।
অনেকটা সুরমা রংয়ের এই কবুতরের প্রতি সিলেটবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত শ্রদ্ধাপুর্ণ। এ কবুতর শহরের বিভিন্ন স্থানে অবাধ বিচরণ করলেও কবুতর শিকার, বিক্রয় কিংবা খাওয়ার কথা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারে না। লোক বিশ্বাস যার বাড়িতে এরা বাসা বাঁেধ তার মঙ্গল হয়। অনেকের বিশ্বাস এ ধরনের কবুতর অন্যান্য স্থানে দেখা যায়না। তবে মক্কা শরীফে ও মদিনা শরীফে এ ধরনের কবুতর রয়েছে বলে ভক্তবৃন্দের নিকট হতে জানা গেল।
এই চত্বর থেকে সামান্য দুরে গিয়েই চোখে পড়লো একটি পুকুর। এই পুকুরে রয়েছে অসংখ্যা গজার মাছ। এই গজার মাছের প্রতিও মানুষের অসীম ভক্তি। জনশ্রুতি আছে হযরত শাহ জালাল (রঃ) যে স্থানে বসে ওযু করতেন সেই জলাশয়ে একটি গজার মাছ অসংখ্য পোনাসহ ভেসে ওঠে। তিনি মাছগুলি দেখে মুগ্ধ হন এবং মাছগুলিকে নিধন না করার নির্দেশ দেন। সে থেকেই টিকে আছে গজার মাছ। যদি কোন কারনে একটি মাছ মারা যায় তাহলে তাকে কবর দেওয়া হয়।
এবারে ফেরদৌস আমাদের নিয়ে গেলেন আজব ঝরনা দেখাতে। মাজারের পশ্চিমে সমতল ভুমিতে এই ঝরনাটি চারিদিকে দেয়াল ঘেরা। আঙ্গিনার ভেতরে উঁচু করে চারকোনা বিশিষ্ট ঝরনার অবস্থান। ঝরনার উপরে লোহার গ্রিল দেয়া। ঝরনা থেকে অনবরত পানি বের হয়। এক সময় এই ঝরনাতে সোনালী কৈ মাছ ও মাগুর মাছ ভেসে বেড়াতো।
জনশ্রুতি রয়েছে মক্কার জমজম কুপের সাথে এই কুপের সংযোগ রয়েছে। আজব ঝরনা পরিদর্শন শেষে আমরা দরগাহ শরীফের ডেকচি দেখতে গেলাম। মুসাফির খানার পুর্বদিকে একতলা ঘরের ভেতর বড় বড় তিনটি ডেকচি রয়েছে। এগুলো ঢাকার মীর মোরাদ বক্স দান করেছেন। মীর মোরাদ ঢাকার হোসেনী দালান তৈরি করেন। তিনি ছিলেন নত্তরা মহালের (জনপথ বিভাগ) দারোগা। যদিও ডেকচি গুলোতে রান্না করা হয় না তবুও কথিত আছে এর প্রত্যেকটিতে সাতটি গরুর গোশ্ত এবং সাতমণ চাল একসাথে রান্না করা যায়। ডেগ বা ডেকচির কিনারে ফার্সিতে লেখা রয়েছে যার বাংলা অনুবাদ “১১০৬ হিজরীর ১২ রমজান (১৬৯৫) জাহাঙ্গীর নগর নিবাসী ইয়ার মুহাম্মদের পুত্র জাফর, তার পুত্র শেখ আবু সাঈদ কর্তৃক ডেকচিটি তৈরি হয়ে মুরাদবক্স কর্তৃক এই ডেকচিটি দরগাহ শরীফের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হলো। হযরতের কসম সীমানার বাইরে যেন এই ডেকচিটি নেয়া না হয়। এর ওজন পাঁচ মণ তিন সের দুই পোয়া মাত্র।
হযরত শাহ জালাল (রঃ) এর ব্যবহৃত তলোয়ার, খড়ম, বর্তন ও বাটি মাজারের দক্ষিন দিকের মুফতি মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন আহমদের বাড়ীতে সংরক্ষিত রয়েছে। ২০ জেলকদ তারিখে ওরছের সময় এগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়।
এক সময় আসরের আযান ধ্বনি মধুর কন্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো। আমরা নামাজ আদায়ের জন্য মাজার মসজিদে প্রবেশ করলাম। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।