হজরত খানজাহান আলী (র.) এর মাজারে একদিন

// এবাদত আলী
মংলা ফেরিঘাটে ট্রলারবোট থেকে নেমে সোজা বাসের সিটে গিয়ে বসা হলো। আবহাওয়ার খবর ভালো করে না জেনে সুন্দরবন ভ্রমণে বের হবার জন্য আয়োজককে বার বার দোষারোপ করা হলো। কিন্তু উপায় কি? বিপদ তো আর বলে কয়ে আসেনা। সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য গত ২১ অক্টোবর’২০১০ রাতে পাবনার টেবুনিয়া থেকে আমাদের রিজার্ভ বাস রওনা হয়ে পরদিন ভোর বেলা মংলা ফেরিঘটে গিয়ে পৌঁছে। কিন্তু ওই রাতেই মংলা বন্দর এলাকায় আবহাওয়া দপ্তর ৩নং সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলে। তা সত্তেও আমরা ভোর বেলা ২২ অক্টোবর একটি ট্রলারবোট ভাড়া করে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা হই। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ার কারণে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। পশুর নদীতে উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে আবার মংলা ফেরিঘাটেই ট্রলার এসে থামলো। অগত্যা হজরত খানজাহান আলী (র.) এর ষাটগম্বুজ মসজিদ ও মাজার দর্শনের জন্য নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
এদিন শুক্রবার বিধায় স্থানীয় রেস্টহাউসে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদে জুমা’র নামাজ আদায় করার প্রস্তুতি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের বাসটি এক সময় মংলা রোড থেকে বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে মোড় নিলো। মসৃন পাকা সড়ক। দুধারে ঘন বন-জঙ্গল। মাঝেমধ্যে গোলপাতার ছাউনির দুএকটি বাড়ি-ঘর। নিঝুম নিস্তব্ধ এলাকা দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর একসময় আমাদের কাংখিত ষাটগম্বুজ মসজিদ পাওয়া গেল।
বাগেরহাট জেলার সদর থানার সুন্দরঘোনা গ্রামের বিশাল দিঘির পুর্ব পাড়ে ষাটগম্বুজ মসজিদ অবস্থিত। মসজিদটির দৈর্ঘ ১৫৯ ফুট এবং প্রস্থ ১০৫ ফুট। ৬০টি পাথরের স্তম্ভের উপরে ৮১টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির নাম ষাটগম্বুজ হওয়ার সঠিক কোন তথ্য জানা যায়না। অনেকের ধারণা যে, মসজিদে ৬০টি স্তম্ভ আছে বলেই ষাট গম্বুজ মসজিদ বলা হয়ে থাকে। আবার অনেকের মতে মসজিদের উপর সাত সারি গম্বুজ আছে বিধায় সাত থেকে ষাট গম্বুজ নামকরণ হয়েছে। মসজিদটির নির্মাণ শৈলী প্রাচীন মুসলিম ঐতিহ্যের গৌরবময় অধ্যায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রত্নতত্ব বিভাগ কর্তৃক মসজিদটি রক্ষনাবেক্ষণ করা হচ্ছে। দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য মসজিদ সংলগ্ন একটি বিভাগীয় বিশ্রামারগার নির্মাণ করা হয়েছে।
এই ষাট গম্বুজ মসজিদটি ছিল একসময় “ খলিফাতে আবাদ” সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাংলার সর্ববৃহৎ মসজিদ, দিঘি ও রাস্তা নির্মাতা এবং মুসলিম ইতিহাসের সর্বাাধিক কীর্তিমালার অধিকারি ওলিয়ে কামেল হযরত উলুঘ খান-ই জাহান (র.) এর দরবার গৃহ। ৪৪টি গ্রাম নিয়ে গঠিত তাঁর রাজধানীকে হাবেলী খলিফাতাবাদ বলা হতো। এই রাজধানীতেই তিনি খনন করেছেন ৩৬৫টি দিঘি, নির্মাণ করেছেন ৩৬০টি মসজিদ এবং ৩৬৩টি রাস্তা। যার একটি রাস্তা বাগেরহাট থেকে চট্রগ্রাম পর্যন্ত এবং অপর একটি রাস্তা দিল্ল¬ী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাঁর খনিত বৃহৎ দিঘি ‘খাঞ্জেয়ালি দিঘি। এই দিঘিতে আজো আছে তাঁর পোষা কুমির ধলাপাহাড় ও কালাপাহাড়ের বংশধরেররা।
যতদুর জানা যায় হযরত খানজাহান আলী (র.) ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে নায়েবে রাসুল হযরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (র.) এর আওলাদ তুর্কি বীর যিনি জেহাদের পয়গাম নিয়ে ৬০ হাজার মুজাহিদসহ সুদুর দিল্ল¬ী জৈনপুর গৌড় হতে হিজরত করে সেন রাজা গণেশ এবং দুর্ধর্ষ মগ রাজা কর্নওয়ালিকে পরাজিত করে এই বাগেরহাটে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। সুদীর্ঘ ৫০ বছর ধরে তিনি রাজশাহী, পাবনা, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালি,তথা সমগ্র ভাটি এলাকাব্যাপি পুর্নাঙ্গ ইসলামী খেলাফত কায়েমের পর ৯০ বছর বয়সে ৮৬৩ হিজরীর ২৬ জেলহজ্ব মোতাবেক ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর তিনি ইন্তেকাল করেন।
কামেল ওলি হযরত খানজাহান আলী (র.) এর জীবনী সম্পর্কে আরো যে সব তথ্য রয়েছে তা হলো এই মহান সাধকের পুর্ব পুরুষ সম্ভবত সৌদি আরবের বাসিন্দা ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁরা ইসলাম ধর্ম প্রচারার্থে তুরস্কে এবং শেষে বাগদাদে বসতি স্থাপন করেন। বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা যায় যে, ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসের সময় তাঁর পিতামহ সেখান থেকে পালিয়ে দিল্ল¬ী আগমণ করেন। আনুমানিক ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে খানজাহান আলী দিল্ল¬ীতে জন্ম গ্রহণ করেন। বাল্য অবস্থায় তাঁর পিতা মাতা তাঁকে নিয়ে গৌড়ে আগমণ করেন। (গৌড় বর্তমানে ভারতের মালদহ জেলায় অবস্থিত।) গৌড়ের নিকটবর্তী নবীপুরে তাঁদের বসতবাড়ি ছিল। তাঁর বাল্য নাম শেরখাঁ বা কেশর ফরিদ খাঁন। বাল্যকালে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। তাঁদের আর্থিক অবস্থা খারাব থাকায় তিনি জৈনপুরের পরাক্রমশালী সুলতান ইব্রাহিম সাকির অধিনে একজন সাধারণ সৈনিকের চাকরি গ্রহণ করেন। কিন্তু স্বীয় প্রতিভাবলে অতি অল্পকালের মধ্রেই তিনি প্রধান সেনাপতির পদ অলঙ্কিত করেন।
তৎকালিন দিনাজপুরের রাজা গণেশ গৌড় অধিপতি সামসুদ্দিন হামজা শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সুলতানের প্রধান সেনাপতি কেশর ঁখান বা খাঁনই-জাহান রাজা গণেশকে বন্দি করে রাখেন। কিন্তু পরবর্তীালে একটি সন্ধির মাধ্যমে রাজা গণেশ ছাড়া পেয়ে পুণরায় চক্রান্তে লিপ্ত হয়। রাজা গণেশের সৈন্যবাহিনী সুযোগ বুঝে তাঁর মাকে বন্দি করে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করে। এই সংবাদে খানজাহান আলী শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। দুনিয়ার প্রতি তাঁর আর কোন মোহই থাকেনা। তার মন আধ্যাত্মিক চেতনায় বিভোর হয়ে পড়ে। তিনি তাঁর পীরকেবলার সান্নিধ্যে থেকে মারফতি বিদ্যা আয়ত্ব করতে থাকেন। একসময় তিনি পুর্ণতা হাসিল করেন এবং ইসলাম প্রচার করতে করতে গৌড় হতে বরেন্দ্র ভুমি পার হয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। প্রথমে তিনি কৃঞ্চনগর, পাবনা ও রাজশাহীতে ইসলাম প্রচারের পর আরো পুর্ব ও দক্ষিনে অগ্রসর হতে থাকেন। যশোরের বারোবাজার নামক স্থানে এসে আস্তানা স্থাপন করেন। এখান থেকে মুরলি, বিদ্যানন্দকাঠি, পরগ্রাম, বাসরি, সুভরা, রানাগাতি, দিঘুলিয়া, সেনের বাজার, তালিমপুর ইত্যাদি এলাকার মধ্য দিয়ে ষাটগম্বুজের বারাকপুরের সন্নিকটে এসে ছাউনি ফেলেন এবং খলিফাতে আবাদ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন।
খানজাহান আলী এদেশে এসে সোনাবিবি ও রূপাবিবি নামে দু রাজকুমারিকে বিয়ে করেন। জনশ্রুতি আছে এই আধ্যাত্মিক পুরুষ রাতের বেলা বাঘ ও কুমিরের পিঠে চড়ে রাজ্যময় ঘুরে বেড়াতেন এবং প্রজাদের সুখ-দুঃখের খোঁজ খবর নিতেন। তিনি বাগেরহাটের সুপ্রদ্ধি ঠাকুর দিঘি বা খাঞ্জেয়ালি দিঘির উত্তর পাড়ে বসবাস করতেন। প্রাচির বেষ্টিত এই বসতবাটিতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। মহান সাধক হযরত খানজাহান আলী (র.) জীবিত থকাবস্থায় নিজেই নিজের মাজার নির্মাণ করেছিলেন। ষাটগম্বুজ মসজিদ হতে আড়াই কিলোমিটার দুরে এই মাজার অবস্থিত।
আমরা ষাটগম্বুজ মসজিদে জুমা’র নামাজ আদায় শেষে হযরত খানজাহান আলী (র.)এর মাজার জিয়ারতে গেলাম। পায়ে হেঁটে মাজারের প্রধান গেট পার হয়ে কিছুদুর যাবার পর চোখে পড়ে বিশাল একটি জলাশয় বা দিঘি। যা খাঞ্জেযালি দিঘি নামে পরিচিত। এই দিঘির উত্তর পাড়ে টিলার উপরে তাঁর মাজার। এক গম্বুজ বিশিষ্ট ৩০ হাত বর্গাকৃত পাথরের ভিতযুক্ত তাঁর সমাধিসৌধের মধ্যে সম্পুর্ন পাথরের তৈরি মাজার গাত্রে বিভিন্ন শিলালিপি উৎকীর্ণ আছে। লিপিগুলোতে কালেমা শরীফ, আল্লাহর ৯৯ নাম। চার খলিফার নাম। পবিত্র কোরআন শরীফের আয়াত, ফারসি কবিতা, খানজাহান আলীর মৃত্য ও দাফনের তারিখ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ রয়েছে। একটি দামি সুদৃশ্য গিলাফ দ্বারা তাঁর মাজার আবৃত করে রাখা হয়েছে। মাজারটির চারপাশে রেলিং দ্বারা ঘেরা । পুরুষ ও মহিলাদের জন্য মাজার জিয়ারতের পৃথক ববস্থ্যা রয়েছে। আমরা মাজার জিয়ারত শেষে আমাদের বাসের সিটে গিয়ে বসলাম। এবার বাড়ি ফিরবার পালা। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।