// এবাদত আলী
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। কিন্তু আমাদের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে সে ভাষণ শোনা সম্ভব হলোনা। পুর্ব-পাকিস্তান রেডিও সেন্টার বিকালের দিকে হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল। সন্ধ্যায় বিবিসির খবরে যা শেনা গেল তাতে আমরা অনুমান করলাম বেশ বড় ধরণের কিছু একটা হতে যাচ্ছে।
পর দিন সকাল ৮টার পরে Ÿঙ্গবন্ধুর ভাষণ পুন:প্রচার করা হবে বলে রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা করা হলে আমরা সকলে একত্রে রেডিওর সামনে বসে পড়লাম।
৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উপস্থিতিতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ভাষণে তিনি সকলকে মুক্তি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বল্লেন।
তিনি যা বল্লেন, তা হলো ‘‘ আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু দুঃখের বিষয়- আজ ঢাকা চট্রগ্রাম রাজশাহী রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়-বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় ২৩ বছরের করুন ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করারর ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমুর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস রক্ত দানের করুন ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও ক্ষমতায় বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইন জারি করে আইয়ুব খান ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রাখলো। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেওয়া হলো এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হলো। ১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলনে আইয়ুবের পতনের পর ই্য়াহিয়া খান এলেন। তিনি বল্লেন তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন শাসনতন্ত্র দেবেন আমরা মেনে নিলাম। তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা হলো আমরা তাকে ১৫ ফেব্রয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। কিন্তু মেজরিটি পার্টির নেতা হওয়া সত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেননা। শুনলেন সংখ্যালঘুদের ভুট্রো সাহেবদের কথা।
আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। ভুট্রো সাহেব বল্লেন মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে তিনি মার্চের ৩ তারিখে অধিবেশন ডাকলেন। আমি বল্লাম তবু আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্বেও কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব এমন কি তিনি যদি একজনও হন।
জনাব ভুট্রো ঢাকা এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা হলো। ভুট্রো সাহেব বলে গেছেন আলোচনার দরজা বন্ধ নয় আরো আলোচনা হবে। মওলানা নুরানী ও মুফতি মাহমুদসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যন্য পার্লামেন্টারি নেতা এলেন তাদের সঙ্গে আলোচনা হলো উদ্দেশ্য ছিলো আলাপ আলোচনা করে শাসনতন্ত্র রচনা করবো। তবে তাদের জানিয়ে দিয়েছি ৬ দফা পরিবর্তনের কোন অধিকার আমার নেই।………… তিনি আরো বলেন
“তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে। আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে দিবে।
তিনি পাকিস্তনি সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বল্লেন, তোমরা আমার ভাই তোমরা ব্যারাকে থাকো। আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করোনা। ভাল হবেনা। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি- তখন রক্ত আরো দেবো। বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। তিনি আরো বল্লেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ”
এ দিন বিকাল বেলা আমরা আবার একত্রে মিলিত হলাম। ইতোমধ্যে একটি টিনের চোঙা বা চোঙ বানানো হয়েছে। যার সাহায্যে সকলকে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে একত্রিত করা যাবে। এ ছাড়া বাঙ্গাবাড়িয়া মাদ্রাসার কাঁসার বেল বা ঘন্টা আমরা আমাদের দখলে নিয়ে নেই। জরুরি প্রয়োজনে চোঙ দ্বারা ডাকা ডাকি করা কোন কারনে অসুবিধা হলে যে কেউ বেল বা ঘন্টা বাজালেই আমরা সকলেই যেন সল্প সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট একটি স্থানে মিলিত হতে পারি। তখন এমনি ভাবে দারু উদ্বিগ্ন আর উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা দিন গুলো অতিবাহিত করছিলাম।
দেখতে দেখতে ২৫শে মার্চ এসে গেল। এই রাতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরপরাধ নীরিহ নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালীর জাতীয় জীবনে এক দুর্যোগ পুর্ন কাল রাত। নীরিহ নিরস্ত্র জনসাধারণ যখন গভীর নিদ্রায় সমাচ্ছন্ন তখন অতর্কিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের ওপর সয়ংক্রিয় অস্ত্র, কামান, মর্টার ও ট্যাংক বহর নিয়ে আক্রমণ করে রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে। ‘২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পুর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন ইপিআর হেডকোয়ার্টার, জগন্নাথ কলেজসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তাানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক হামলা করা হয়।
পাবনা জেলাতেও তার ঢেউ এসে লাগে। কারণ পাবনার নুরপুর ডাকবাংলো, মেন্টাল হসপিটাল এবং কাশিপুর শিল্প নগরীতে তখন পাাকস্তানি সেনাদের ছাউনি বিদ্যমান ছিল। পাবনা জেলার দামাল ছেলেরা, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই একমনে এক প্রাণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এমনিতেই পাবনার মানুষ একটু বেপরোয়া তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এডভোকেট আমিনুদ্দিন, আ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন, আব্দুল গণি, ওয়াজি উদ্দিন খাঁন উদ্দিন ভাই, আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন, এডভোকেট আমজাদ হোসেন ও আবদুর রব বগা মিয়াদের তত্বাবধানে ৩ মার্চ ‘৭১ থেকে অসহযোগ আন্দোলন পুরোপুরি ভাবেই পালিত হচ্ছিল। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাবনায় জনসভা করতে এসে আলাপ চারিতার এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘আমি পাবনাকে নিয়ে ভাবিনা, পাবনাতো আওয়ামী লীগের দুর্গ। ’ ২৫ মার্চ রাতে এই দুর্গেই আঘাত হানে পাকিস্তানি সেনারা।
২৩ মার্চ ১৯৭১ পাবনাতে ব্যাপক মহড়া গণমিছিল ও বিশাল জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এদিন পাবনা টাউন হল মাঠে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পাবনা জেলা আহবায়ক সাহবিুদ্দিন চুপ্পু, ছাত্র লীগ নেতা আব্দুস সাত্তার লালু, সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বকুল, ছাত্র নেতা, মোহাম্মদ ইকবাল, আ স ম আব্দুর রহিম পাকন, প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে পাবনার ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে।
এর ফলে সারা শহরে পাকিস্তানি সেনারা টহল বাড়িয়ে দেয় এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাত্র লীগের নেতা-কর্মীদের পাকড়াও করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।