এবাদত আলী
তখন আমি পাবনার বনওয়ারিনগর ফরিদপুর থানার ড়েমরা তহসিল অফিসে চাকুরি করি। একদিন হঠাৎ করে ফরিদপুর থানার সিও রেভ আকস্মিকভাবে অফিস পরিদর্শনে এলেন। অর্থাৎ সারপ্রাইজ ভিজিটে এলেন। তিনি অফিসের যাবতীয় বিষয়াদি দেখলেন। আমাকে বললেন আপনি কি কাজ করেন। আমি কোন কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই হেড তহসিলদার অর্থাৎ বড়বাবু বল্লেন উনি কাজ শিখছেন। সিও সাহেব বললেন কয়েকমাস হলো তিনি শুধু কাজই শিখছেন না তাকে খাটিয়ে নেয়া হচ্ছে। তাকে আর আর বই দিয়ে দেন এবং দুএকটা মৌজাও দেন যাতে নিজে নিজে আদায় করতে পারে।
এই কথায় বেশ কাজ হলো। আমাকে আর আর বই অর্থাৎ রেন্ট রিসিট বই দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে কাঠ পেন্সিল ও কার্বন দেওয়া হলো। পুঙ্গলি ইউনিয়নের আগপুঙ্গলি, মধ্য পুঙ্গলি, নারায়নপুর, হারনী মৌজা এবং ডেমরা ইউনিয়নের ডাকবাড়িয়া ও চকোরিয়া মৌজা খাজনা আদায়ের জন্য দেয়া হলো। সঙ্গে পিয়ন হিসেবে আব্দুল আজিজকে দেয়া হলো। এবার আমার কর্তব্য ও দায়িত্ব বহু গুনে বেড়ে গেল। খাজনা আদায়ের জন্য গ্রামে গ্রামে পায়ে হেঁটে ঘুরতে হতো। তবে সপ্তাহের দুটি হাটবারে কোথাও যেতে হতোনা। জমির মালিকেরা হাটে আসতেন সেই সাথে খাজনাও দিয়ে যেতেন।
জমি-জমা মানুষের অমুল্য সস্পদ। এই জমি-জমা সচ্ছ বা নির্ভেজাল রাখতে প্রতি বছর জমির খাজনা দিতে হয়। জমির মালিকগণ একথা পুর্বে থেকেই জানে। অন্যান্য প্রায় সকল বিষয় খ্রিষ্টাব্দ বা ই্ংরেজি সন অনুসারে সামাধা করা হলেও জমির খাজনার সন হলো বাংলা সন। সুদুর জমিদারি আমল থেকেই এই প্রথা চালু আছে। জমিদারের অধীনে খাজনা আদায় কালে নায়েব মহাশয়গণ বাংলা সনের প্রথম দিন অর্থাৎ প্রতি বছর ১লা বৈশাখের দিন পুন্যাহর ব্যবস্থা করতেন। এই পুন্যাহর সময় প্রজাগণ আনুষ্ঠানিকভাবে জমির খাজনা পরিশোধ করতেন।
এভাবে বেশ ভালোভাবেই দিন কেটে যেতে লাগলো। সকলে মিলে মেসে খাওয়া। মাছ, গোশত যখন যেটা মন চায়। তিন আনা সের দুধ ক্রয় করা হতো কাচারিতে বসেই। বড়াল নদী হতে জেলেরা বিভিন্ন প্রকারের মাছ ধরতো। বোয়াল, বাইন, কালবাউশ, রিঠা, আইড়, কাউনে, শৈল, গজার, চিতল মাছ জালে ধরা পড়তো। আর ধরা পড়লেই কাচারির বাবুদের জন্য তা তারা নিয়ে আসতো। কাচারির বাবুরা বাজার মুল্যের চেয়ে একটু বেশি মুল্য দিতো। পুরো বর্ষাকালে ইলিশ মৌসুমে ইলিশ ধরা পড়লেই জেলেরা কাছারিতে নিয়ে আসতো। বটিতে কাটার সময় তাজা ইলিশ লাফালাফি করতো তখন আমরা তা মজা করে দেখতাম। তাজা ইলিসের যে কি স্বাদ তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। মাছের দাম খুবই কম। বড় সাইজের একটি ইলিশ এক টাকাতেই পাওয়া যেতো। অন্যান্য মাছের দাম আরো সস্তা। তখন জলাজলকর তহসিল অফিস থেকেই নিলামে ডাক হতো। নিলামে ডেকে নেওয়া জেলেরা বড়সড় মাছ পেলে তা জলার মালিক অর্থাৎ তহসিল কাচারির বাবুদের জন্য তা কাচারিতে পাঠাতো।
একবার কালিয়ানি খেয়া ঘাটের জেলেরা একটি ১২ সের ওজনের চিতল মাছ কাচারিতে নিয়ে এলে বড় বাবু তা উপর তলায় নিয়ে কাটাকুটা করে বড় পাতিলে করে জাল দিয়ে রাখেন। ভাগ্যক্রমে জেলেদের একজনের সাথে পথে আফজাল মিয়ার দেখা হলে সেই মাছের কথা জানায়। আফজাল বিষয়টা আমাদেরকে জানালে আমরা বড়বাবুর উপর রাগান্বিত হই এবং আফজাল বলে আমি উপর তলা থেকে গোপনে কিছু মাছ নিয়ে এসে রান্না করে আমরা কজন খাবো। তাই করা হলো। রাতের বেলা চিতল মাছ রান্না হলো। বড়বাবু তা টের পেলেননা। তিনিও উপর তলায় তার মত করে চিতল মাছ রান্না করে খেলেন। কিন্তু পাতিলের মাছ কতটুকু আছে তাতো নতুন বাবুর্চি জানেনা। তাই তিনিও টের পাননি। যে যার মত করে পাল্লা দিয়ে তৈলাক্ত চিতল মাছ খাওয়া হলো। কিন্তু ভোর হতে না হতেই পায়খানায় যাওয়া আসার পালা শুরু হলো। একজন যায়তো অন্যজন অপেক্ষা করে। কেউবা বিলম্ব দেখে ঢিলের মাঠের মধ্যে গিয়েই কার্জ সমাধা করতে থাকে। পরে কথা জানাজািিন হয়ে যায়। এতে সকলেই লজ্জা পাই। আমাদের মেসে সারা মাস খাবারের পর জনপ্রতি মেসের খরচ পড়তো ২২ থেকে ২৩ টাকা। মাসিক ১শ টাকা বেতনের চাকরিতে বেশ ভালোভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো।
ডেমরা কাচারির সহকারি তহশিলদার নজরুল মিয়া ছিলেন একজন গানের শিল্পি। তার রুমে হারমোনিয়াম ও ডুগি তবলা থাকতো। প্রায় প্রতিদিন কাজ শেষে রাতের বেলা তহসিল কাচারিতে গানের আসর বসতো। আশে পাশের দুএকজন গানের শিল্পীও এসে এ আসরে যোগ দিতেন।
হঠাৎ করে সহকারি তহসিলদার নজরুল হকের বদলির আদেশ হলে তিনি বদলি হয়ে চলে গেলেন। তাঁর বদলিতে অবশ্য আমার কিছুটা লাভ হলো। কারণ তিনি যে রুমে থাকতেন সেই রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা হলো।
ইতোমধ্যে এই এলাকার অনেকের সাথেই পরিচয় হয়ে গেল। ডেমরা হাইস্কুলের সহকারি শিক্ষক আবু জার গাফ্ফারির সঙ্গে রীতিমত বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বলতে গেলে সারা বিকালটা আমরা একসঙ্গে কাটিয়ে দিতাম। আর সম্পর্ক গড়ে ওঠার আরেকটি কারণ হলো তিনি একজন লেখক। আমার লেখালেখির অভ্যাস তখনো ছিলো বিধায় দুজনের বন্ধুত্ব পাকাপোক্ত হলো। বিকাল হলেই আমরা দুজন ডেমরা বাজারের উত্তরে শ্মশান ঘাটের পাশে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসতাম। কখনো কখনো বিলের মাঝে বাঁধের উপরে গিয়ে বসতাম। আবার কোন কোন কোন দিন ডিঙি নৌকা নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়তাম। নৌকা চালাতো আমার অফিসের পিয়ন আলিমুদ্দিনের বড় ছেলে আলাউদ্দিন। সে তখন ডেমরা স্কুলে ক্লাশ নাইনের ছাত্র। বাবার চাকুরির সুবাদে সে কাচারিতে আসতো এবং কাচারির ষ্টাফদের ফাই ফরমাশ খাটতো। আমরা তিনজনে মিলে বড়াল নদী কিংবা ডেমরা বিলের মাঝে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াতাম।
। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।