সঞ্জু রায়, বগুড়াঃ রুখবো দুর্নীতি, গড়বো দেশ, হবে সোনার বাংলাদেশ স্লোগানে বগুড়ায় বুধবার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো দুর্নীতিবিরোধী গণশুনানী। দুর্নীতি দমন কমিশন এর আয়োজনে শহরের টিটু মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই শুনানীতে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে ৩৪টি অভিযোগের সরাসরি শুনানী করেন দুদক প্রধান কার্যালয়ের কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান যার মাঝে প্রায় ২০টি অভিযোগই ছিলো বগুড়ার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের বিরুদ্ধে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে গণশুনানীর উদ্বোধনী আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমাদের দেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও এখন একটি সংগ্রাম চলছে যা হলো মুক্তির সংগ্রাম। সাধারণ মানুষের অধিকার বঞ্চিত করা, ঘুষ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি এই অপকর্মগুলো দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে যে লড়াইয়ে আমাদের জয়ী হতে হবে। তবে শুধু আইন দিয়ে কিংবা দুদকের একার পক্ষে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সকলকে নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে আগে নিজেকে সচেতন হতে হবে। তবে তিনি সরকারি সেবাপ্রদানকারী কর্মকর্তাদের তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালনে আরো আন্তরিক ও শতভাগ স্বচ্ছ হওয়ার লক্ষ্যে হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি করলে শেষ পর্যন্ত কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা। সেবাগ্রহীতাদের সাথে সদা আন্তরিক ব্যবহার করারও নির্দেশনা দেন তিনি।
উদ্বোধনী সভায় আরো বক্তব্য রাখেন দুদক প্রধান কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন, বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম, পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বিপিএম পিপিএম এবং জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোজাম্মেল হক। দুদক বগুড়া জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো: মনিরুজ্জামানের ব্যবস্থাপনায় সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন দুদক রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক কামরুল আহসান।
দুর্নীতি বন্ধে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ও হয়রানির অভিযোগ সরাসরি শোনার ব্যতিক্রমী কর্মসূচি দুদকের গণশুনানীতে বগুড়ার সকল সরকারি স্বায়িত্বশাসিত দপ্তরের প্রধানসহ বিভিন্ন মহলের হাজারো মান্ষু উপস্থিত ছিলেন যেখানে সাধারণ মানুষ সরাসরি তাদের অভিযোগ দাখিল করেন এবং দুদক কমিশনার তাৎক্ষণিক তা আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
দিনব্যাপী শুনানীতে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসে সেটেলমেন্ট অফিস, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, ইউনিয়ন ভূমি অফিস, এসিল্যান্ড কার্যালয়, সাব-রেজিষ্ট্রার কার্যালয়, নির্বাচন অফিস, বিআরটিএ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি দপ্তরের বিরুদ্ধে। যেখানে সাধারণ মানুষেরা অবৈধ পন্থায় ঘুষ গ্রহণ, সেবা প্রদানের নামে হয়রানি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সেবা নিতে গিয়ে দূর্ব্যবহার এর স্বীকার হওয়াসহ নানা অভিযোগ করেন।
শুনানীতে উল্লেখযোগ্য অভিযোগের মাঝে ছিলো, বগুড়া সদরের ফাঁপোড় এলাকার রাবেয়া খাতুন জমি খারিজ করে খাজনা দিতে গিয়েছিলেন ভূমি অফিসে। সেখানে খারিজ করে দেয়ার জন্যে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন ইউনিয়ন ভূমি অফিসার শাহীন। দাবিকৃত টাকা না দেয়ায় এখনও তার কাজ হয়নি। এদিকে বিষয়টি প্রমাণ করতে পারলে সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয় শুনানিতে। এছাড়াও বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে ঘুষের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন বগুড়ার সদরের গোকুলের বাসিন্দা হেলাল। তিনি দু মাস আগে তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে তাকে ঘুষ দিতে হয় বলে দুদক কমিশানের কাছে অভিযোগ করেন হেলাল। হেলাল জানান, তার মাকে ভর্তি করানোর সময় ২০০ টাকা দিতে হয় হাসপাতাল কর্মচারীকে। পরবর্তীতে ভর্তির পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় হুইল চেয়ারের প্রয়োজন হলে আরেক কর্মচারীকে ২০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এ ছাড়াও নার্সদের দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ করেন হেলাল।
এ বিষয়ে শজিমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ওই সময় সুনির্দিষ্ট প্রমানসহ অভিযোগ করলে তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতেন। তবে বিষয়টি খোঁজ করা হবে। এর বিপরীতে তিরস্কার করে দুদক কমিশনার বলেন, এসব অভিযোগের কারণে এমন গণশুনানীতে আপনাদের আসাটাই লজ্জার। আপনারা ব্যবস্থা নিবেন সেটা পরের বিষয়। কিন্তু হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে অভিযোগ পুরোনো। এ জন্য আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত। সাধারণ মানুষ বিপদে পড়ে আপনাদের কাছে আসে। আপনারা নিজেদের সেবার মান উন্নত করবেন, এটাই আমাদের কাম্য।
এমনই প্রায় ৩৪টি অভিযোগের সরাসরি শুনানী করেন দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক। অধিকাংশ সমস্যার বিষয়েই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দ্রæত সমাধানের লক্ষ্যে সময় বেঁধে দেন তিনি যা পরবর্তীতে দুদক বগুড়ার কর্মকর্তাদের মনিটরিং করার নির্দেশ দেন তিনি। এছাড়াও সফটওয়্যার কিংবা দাপ্তরিক সমন্বয়হীনতার জন্যে যে কাজগুলো সমাধান করতে দেরি হচ্ছে তাও দ্রæত সমাধানে জেলা প্রশাসককে সমন্বয়ের জন্যে নির্দেশ দেন এই কর্মকর্তা।
দুর্নীতি যখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে তখন তৃণমূল পর্যায়ে দুদকের এই আয়োজনকে ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবেই দেখছেন সাধারণ জনগণ । তাইতো সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলা এই গণশুণানীতে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো। একদিন দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে এবং সকল দপ্তরে গিয়ে সাধারণ মানুষ হয়রানিমুক্ত স্বচ্ছ সেবা পাবেন সেই প্রত্যাশায় ব্যক্ত করেছেন সকলে।