।। স্টাফ রিপোর্টারঃ
কখনও ভিসি, কখনও ডক্টর, কখনও এমফিল, কখনও সম্পাদক, সাংবাদিক নেতা টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক। আবারও কখনও আদম ব্যবসায়ী। আবার মেডিকেল প্যারা মেডিকেল, নার্সিং ইন্সটিটিউট, বিএড, এমএড, টেকনিক্যাল স্কুল, টেক্সটাইল স্কুল এন্ড কলেজ, ক্লিনিক সহ যেখানে যা দরকার সেখানে সে প্রতিষ্ঠানের পরিচয় দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। দুদকের মামলায় স্ত্রীসহ একাধিকবার জেল খাটলেও আবারও নতুন উদ্যোগে শুরু করেছে প্রতারণার ফাঁদ। পাবনার বেড়া উপজেলার নাকালিয়া একটি জমি দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অন্তত অর্ধ শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ড টানিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। এ সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির কথা বলে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে শত কোটি টাকা।
দুর্ধর্ষ এই আর্ন্তজাতিক প্রতারক ও জালিয়াত মোল্লা কফিলের প্রতারনার স্বীকার হাজারো মানুষ নি:স্ব হলেও দেখার কেউ নেই। কখনো ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, কখনো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করে বেড়াসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে বিলবোর্ড ও পোষ্টার সাটিয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালে ২ আগষ্ট পাবনা তথা সারা দেশের দুর্ধর্ষ প্রতারক, উচ্চ শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা ও জালিয়াত চক্রের প্রধান মোল্লা মো: কফিল (৫০) কে গ্রেফতার করে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা। চাঁদাখার বাশতলা এলাকা থেকে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত দুটি মামলায় দুদক উপ-পরিচালক মামুন ইসলাম এবং সহকারী পরিচালক রবীন্দ্রনাথ চাকীর নেতৃত্বে দুদক সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করে। পরে পাবনা থানার মাধ্যমে আদালতে প্রেরণ করে। পাবনার কগনাইজিং আদালতের বিচারক মো: কামরুল হাসান খান তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
দুদক সুত্র জানায়, পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার চাকলা গ্রামের আবু বকর ও কদভানু বেগমের সন্তান মোল্লা মো: কফিল উদ্দিন। তার লেখাপড়া নিয়ে রহস্য থাকলেও তিনি তার নামের আগে ডক্টরেট বসান। কোন স্থান থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন তাও কেউ জানেনা। এ ছাড়া মোল্লা কফিল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বনামখ্যাত ব্যক্তির নাম পরিচয় ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছিল। যুদ্ধাপাধের দায়ে অভিযুক্ত মাওলানা নিজামীর হাত ধরে তার উত্থান ঘটে। এর পর কিছুদিন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর নাম ব্যবহার করেন। এ পর থেকেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে চুটিয়ে ব্যবসা করে আসছিল। সে পাবনা শহরের সিংগায় প্যারামেডিকলে কলেজ, বিএড কলেজ, এমএড কলেজ, টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ, নার্সিং ট্রেনিং ইন্সটিটিউট কলেজ, সাঁিথয়া উপজেলার বিষ্ণুপুরে কথিত শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মুসলিম কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ, নাটোর টেকনিক্যাল কলেজসহ ২৬ টি কথিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সিরাজগঞ্জ, ঈশ্বরদী বেড়া সাঁিথয়াসহ নানা স্থানে অসংখ্য নাম ও প্যাড স্বর্বস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা বলে মানুষজনের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। এ ভাবে মোল্লা কফিল শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন উদ্যোক্তার কাছ থেকে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। সাঁিথয়া উপজেলার বিষ্ণুপুরে এক সময়ের বিখ্যাত সমতা অফিস ভাড়া নিয়ে পরে ঐ ভবন এবং সমস্ত জমি নিজের বলে দাবী করে বসেন এমনকি সমতার চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন।
সুত্র আরও জানায়, পাবনা শহরের সিংগা এলাকায় মুজিব প্যালেস নামে একটি ভবন ভাড়া নিয়ে নানা অপকর্ম করতে থাকে। এ সব বিষয়ে নিয়ে দুদককে অভিযোগ হলে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পায়। পরে এ ব্যাপারে পাবনা সদর থানায় মোল্লা কফিলের বিরুদ্ধে এককভাবে একটি এবং তার স্ত্রী মোছা: মাহমুদুন্নাহার এবং মোল্লা কফিলের বিরুদ্ধে যৌথ আরেকটি মামলা করে। এ মামলা দুটিতে দুদক তাকে গ্রেফতার করে।
এদিকে বিভিন্ন সুত্র জানায়, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ঘনিষ্ট হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিলেও বর্তমান ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের বলেন, “সে এমন জালিয়াত যে একবার আমার বাসায় এসে সেই বাসার কাগজপত্রও দেখিয়ে একটি টেকনিক্যাল কলেজের জন্য আবেদন করেছিল। এর পর আমার ছেলে ডা. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংশ্লিদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে এই ব্যাক্তির সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। সে একজন আর্ন্তজাতিক মানের প্রতারক। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী আরও কিছু অখ্যাত ব্যক্তির দক্ষিনহস্ত ছিলেন। উচ্চ শিক্ষার নামে প্রতারণা মূলক ব্যবসা করে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন না থাকলেও শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বঘোষিত ভিসি ও চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। উল্লেখ্য, মহামান্য রাষ্ট্রপতির একমাত্র ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও তিনি নিজেই বিভিন্ন স্থানে নিজেকে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পরিচয় দেন। গত ১১ জানুয়ারি পাবনা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অভিবাসন বিষয়ে এক সভায় নিজেকে জেলা প্রশাসকের সামনে ভিসি পরিচয় দেওয়ায় জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন তাকে সভা থেকে বের করে দেন।
দুদকের তৎকাণীণ সহকারী পরিচালক রবীন্দ্রনাথ চাকী জানান, জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জণের মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি আরও জানান, দুদক তার সম্পদের হিসাব চাইলে মোল্লা কফিল তার ১ লাখ টাকার সম্পদ আছে বলে দুদকে হিসাব দাখিল করেন। কিন্তু দুদক তার ৩৫ লাখ টাকার জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদরে সন্ধান পায় এবং তার স্ত্রী মাহমুদুর নাহারের সম্পদের হিসাব চাইলে তিনি দাখিল করেন ৩৫ লাখ টাকার সম্পদ আছে তার নামে। কিন্তু দুদক অনুসন্ধ্যানে দেখতে পান মোল্লা কফিলের স্ত্রীর জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ রয়েছে ৪৩ লাখ টাকার। এ সংক্রান্ত ২টি মামলা হয় দুদকে।
তার বিরুদ্ধে নানা রকম আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে স¤প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দল তদন্ত করেন এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন।
মোল্লা কফিল দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও চেয়ারম্যান দাবি করে সরকারের উচ্চমহলে বিভিন্ন অবৈধ ফায়দা হাসিল করে আসছিল। সে কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার নামে স্থানীয় সমতা এনজিও জায়গাও দখল করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ মেডিকেল টেকনোলজি, বিএড, এমএড, কারিগরি কলেজ, টেক্সটাইল কলেজসহ ২৬টি সাইনবোর্ডে সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। তার প্যারা মিডেকেল কলেজ এবং কথিত হাসপাতালের নামে ডেঞ্জারাস ড্রাগস (ডিডি) লাইসেন্স নিয়ে কালোবাজারে প্যাথেড্রিন বিক্রি করেন।
উল্লেখ্য, মোল্লা কফিল বর্তমানের আওয়ামীলীগের কমিটি থেকে বাদ পড়া ধিকৃত এক নেতার আশ্রয় প্রশয়ে বিভিন্ন স্তরে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। তার দাপটে অনেকেই অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে।
এর আগে দুদকের মামলার আসামী প্রতারক ও জালিয়াত মোল্ল¬া কফিলের সিংগাস্থ ‘মুজিব প্যালেস’ এর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে বিদ্রƒৎ বিভাগ। সাড়ে তিন লাখ টাকা বকেয়া থাকায় এবং নিয়মের বাইরে লোড নিয়ে বিদ্যুৎ চুরি করার অভিযোগে পাবনা বিদ্যুৎ বিভাগ ছয়তলা এই ভাড়া ভবনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিভাগীয় মামলা করে। বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, বিউবো বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ ২ বিউবো, পাবনা দপ্তরের আওতাধীন, রাধানগর কলেজপাড়া, আফুরিয়া, পাটকিয়াবাড়ী, সিঙ্গা, শালগাড়িয়া ও নারায়নপুর এলাকায় অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিরদ্ধে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যজিষ্টেট মোঃ জালালুদ্দিন এর নেতৃতে বিশেষ অভিযানের অংশ হিসেবে গত শনিবার এই অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় বিউবো নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ছানা উল্লাহ, সহকারী পরিচালক প্রশাসন আবু তাহের , উপ সহকারী প্রকৌশলী এস এম মাসুদ উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন অটো চার্জিং গ্যরেজ ও বাসা বাড়ীর অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে মোট ১২ টি মামলা দায়ের করা হয় ও ৩ জন আসামি কে গ্রেফতার করা হয়। পাটকিয়াবাড়ী হতে আমিরুল ইসলাম শান্ত এর অটোবাইক সিলগালা করা হয় ও আকুরিয়া মানিক হোসেন এর পলিথিন ফ্যাক্টরী সিলগালা করা হয়। এ সময় দুদকের মামলায় গ্রেফতারকৃত প্রতারক ও জালিয়াত মোল¬া কফিলের সিংগাস্থ ‘মুজিব প্যালেস’ কে ৩ লক্ষ ৫৭ হাজার টাকা ও মানিক হোসেনকে ৭ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকার দায়ে মামালা করা হয়। এ সময় আদালত ৫ লক্ষ টাকার রাজস্ব ক্ষতির বিল করে। পুলিশ প্রশাসন এর কর্মকর্তা ও কর্মচারী ও বিউবো এর কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। অটোবাইক চার্জিং ও অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযান চলমান থাকবে।
এদিকে ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রতারক মোল্লা কফিলসহ তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে পাবনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন পাবনা জেলা জজ আদালতের সহকারী সরকারী কৌশুলী (এপিপি) জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সহসভাপতি কাজী আলম
পাবনা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে কাজী আলম অভিযোগ করেন, তিনি নিজে আওয়ামীলীগের কর্মি এবং এই সরকারের আমলে সরকারী সহকারী কৌশুলী (এপিপি) নিয়োগ পেয়েছেন। তার ৪ চার ভাইয়ের মধ্যে ৩ ভাই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সক্রিয় কর্মি। অপর ভাই সরকারী চাকুরি করেন। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নৌবাহিনীর সাবেক পেটি অফিসার। কাজী আলম সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, অন্তত ২৬টি কথিত প্রতিষ্ঠানের মালিক কথিত মোল্লা কফিল উদ্দিন। স¤প্রতি মোল্লা কফিল তাদের একটি বাড়ী ভাড়া নিয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল টেকনোলজি নামক একটি প্রতিষ্ঠান চালু করে। সে (কফিল) মুলত একজন প্যাথিড্রিন ব্যবসায়ী। স¤প্রতি ভাড়ার মেয়াদ শেষ হলে সে ভাড়া না বাড়িয়ে বাড়ীটি দখলের চেষ্টা করে। এ নিয়ে উভয় ব্যক্তির মধ্যে দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি হয়। এরই এক পর্যায়ে ঐ বছরের ২৭ মার্চ মোল্লা কফিল তার দলবল নিয়ে ২৫/৩০ জন তাদের বাড়ীতে হামলা চালিয়ে টিভি ফ্রিজ, গাড়ীসহ ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করে। এ ব্যাপারে পাবনা থানায় উক্ত ৩ ব্যক্তিসহ ৪০/৫০ জনের নামে মামলা করা হয়।