জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কী হচ্ছে?

আবদুল জব্বার ॥
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫০ বছর পর একক সিদ্ধান্তে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট-সনদ বাতিল করে চলছে মুক্তিযোদ্ধা নিধন। দেশের একটি সুযোগ সন্ধানী স্বার্থন্বেষী মহল বিগত ৪/৫ বছর ধরে একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ এনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে অভিযোগ করে চলছেন। এ সমস্ত বিতর্কীত কর্মকান্ডের সাথে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জড়িত রয়েছে বলে ভূক্তভোগী মুক্তিযোদ্ধারা অভিযোগ করেছেন।
গত বছরের ১২ই ডিসেম্বর দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রথম পাতায় গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদিক শহীদুল ইসলামের লেখা সংবাদের শিরোনাম হলো, “মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শেষ হলোনা ৫১ বছরেও”। তার লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এখনও চুড়ান্ত হয়নি। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্টে গেছে বীর সেনানীদের নাম। কিন্তু টানা ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকেও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদাকারী দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার কর্তৃক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই এখনও শেষ করতে পারেন নি। তিনি লিখেছেন, তালিকা নিয়ে কাজ চলছে ১৩ বছর ধরে এর আগে ৭বার তালিকা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে নির্দিষ্ট ফরমে একজন মুক্তিযোদ্ধা অপর একজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে এবং সাক্ষি হিসেবে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম দিয়ে আবেদন করলেই জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল থেকে তাকে অভিযুক্ত করে নোদিশ জারি করা হয়। এরপর পুর্ব নির্ধারিত দিনে রাজধানীর কাকড়াইলে স্কাউট ভবনে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল কার্যালয়ে হয় শুনানী। আর সেই শুনানী গ্রহণ করেন স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী ।
মাত্র ৫/৭ মিনিটের মধ্যে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে এবং ক্ষমতাবলে অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধার নামে গেজেট ও সনদ বাতিল করা হয়। যে সমস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। এমনকি যাঁরা শুনানীতে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। তাঁদের নামে গেজেট-সদন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী বাতিল করে দিচ্ছেন। আর এভাবেই মহান স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পর জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অসম্মান করা হচ্ছে।
দৈনিক যুগান্তরের বিগত ২০২০ সনে ২৩ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় এ সমস্ত বিষয় নিয়ে ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন তার মিঠে কড়া‘‘ সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন‘‘ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তার লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন , একটি দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন কোন বিষয়ে কাউকে কোনো সনদ প্রদান করেন এবং সুনামধণ্য একই প্রধানন্ত্রীর পরবর্তী মেয়াদে তাঁর কোন মন্ত্রী যদি সেই সনদ বাতিল করে দেন তাহলে সেই ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। আর বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে চলেছে।
এরপর লেখক তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, খোদ আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০১৯ সাল পর্যন্ত তৃণমূল হতে যাচাই-বাছাই করে যেসব মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা (বামস) তালিকা, লাল মুক্তিবার্তা গেজেট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ডাটাবেজ- ইত্যাদিতে অন্তর্ভুক্ত করে তা দেশ ও জাতির মাধ্যমে প্রমাণসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের পরিচয় দিয়েছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করে যাঁদের পরিচয় দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মহোদয় যাঁদের নামে সনদ ইস্যু করেছেন। সেসব সনদ ও পরিচয়পত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ-জাতি ও সমাজ যেখানে সম্মাননা প্রদান করে চলেছেন, এসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামেও দেশের একটি স্বার্থন্বেষী মহল এলোপাথাড়ী অভিযোগ দাখিল করছেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫০ বছর পর দলাদলি, হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা ইত্যাদি কারণে হীন স্বার্থে ব্যর্থ হয়ে কেউ কাউকে অমুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অভিযোগ উপস্থাপন করলেই জামুকা থেকে তাদের নোটিশ দিয়ে জামুকা কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। লেখক এরপর লিখেছেন- স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দীর পর যেসব মুক্তিযোদ্ধা এ ধরনের টানা-হ্যাচরা মোকাবেলা করতে পারছেন না বা শারীরিক মানসিক কারণে এ ধরনের শত্রুতার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন অথবা এই বয়সে এই ধরনের ইঁদুর দৌড়ে শামিল হতে চাচ্ছেন না, মন্ত্রী মহোদয় তাঁদের সমূদয় গেজেট ও সনদ একক সিদ্ধান্তে বাতিল করে দিচ্ছেন।
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় এবং জামুকা থেকে ইস্যুকৃত প্রজ্ঞাপনে এ পর্যন্ত যে সমস্ত ধরনের আদেশ-নির্দেশ ও নীতিমালা হাজির করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীর উপর নয়, সেটি উপজেলা ও জেলা কমিটির উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। কোনো আদেশ-নিষেধ ও নীতিমালাতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে এককভাবে এক সদস্য বিশিষ্ট অভিযোগ গ্রহণ করে অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই এর নামে তাঁদের গেজেট-সনদ বাতিলের কোন ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি।
প্রশ্ন হলো- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সনদ যদি সঠিক হয়ে থাকে, মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদিত গেজেট যদি জাল বা ভুয়া না হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইস্যুকৃত সনদ যদি সঠিক হয়ে থাকে তা’হলে দীর্ঘ ৫০ বছরের স্বীকৃত একজন মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধামন্ত্রী একক সিদ্ধান্তে নিজস্ব ক্ষমতায় অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেন কীভাবে?
এরপর লেখক তার লেখায় প্রশ্ন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় যুগ যুগ ধরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যে তামাশা করে চলেছে, তাতে করে তারা যে বারবার ভুল করবেন বা ভুল করছেন এ কথা বলা মোটেও অযুক্তিক হবে না। এবিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী নাগরিকদের কিছু বলার অধিকার রয়েছে। পাবনা সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই তালিকায় জামায়াত নেতা মুক্তিযোদ্ধা আলী জব্বারকে জামুকা’র প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়েছিল তিনি ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। এরপর জামুকা’র মনোনীত কোনো প্রতিনিধির নাম স্থানীয় কোনো মুক্তিযোদ্ধা বলতে পারেন নি। এর আগে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় যে তালিকা প্রকাশ করেছিলেন, সমগ্র জাতি তা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জরুরী হস্তক্ষেপে সেটি তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা হয়।
পাবনার ঈশ্বরদীর বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুজ্জামান নাসিমের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে জামুকায় মিথ্যা অভিযোগ দেয়া হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতা দিয়ে তার গেজেট ও সনদ রক্ষা করতে পেরেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিমের অপরাধ তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মামলার অন্যতম একজন সাক্ষী। দেশের কোন অশুভ শক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধী মহলের নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যকার একটি অংশ এই রকমের বিতর্কিত ও অন্যায় কর্মকান্ড করে চলেছে বলে অনেক ভুক্তভোগী মুক্তিযোদ্ধারা দাবি করেছেন।
বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, গত ১ নভেম্বর থেকে পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিবাজ মহলের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। গত ১২ নভেম্বর জেলা মুক্তিযোদ্ধা হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা ও উপজেলা ইউনিট কমান্ডের যৌথ উদ্যোগে পাবনা জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা ভবনের সামনে আব্দুল হামিদ সড়কে শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। মানববন্ধন কর্মসূচিতে পাবনার এরকম সুবিধাভোগী স্বার্থান্বেষী মহলের নেতা চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিবাজ মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম বাবলুর নাম পাবনা সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে প্রত্যাহার সহ ৭ দফা দাবি জানানো হয়েছে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ৭ দফা দাবি মেনে নেয়া না হলে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। এ সমস্ত সংবাদ দেশের ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়।
বর্তমান তরুণ সমাজ মহান স্বাধীতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোনো বিভেদ ও বিভ্রান্তি দেখতে চায়না। কারণ ও বিষয়টি যেমন অনাকঙ্খিত তেমনি লজ্জাজনকও বটে। বর্তমান সরকার ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া বীরত্বপূর্ণ রণাঙ্গণের স্থানগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, পাবনার নাজিরপুর বধ্যভূমি সংরক্ষণ করে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণসহ যে সমস্ত স্থানগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বীরেেত্বও স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। এ সমস্ত স্থানগুলেকে চিহ্নিত করে মুক্তিযুদ্ধ সংরক্ষণ প্রকল্পের উদ্যোগে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবী।
বিগত ২০১৭ সালে দেশব্যাপী অনলাইনে আবেদনকারি মুক্তিযোদ্ধাদের যখন যাচাই-বাছাই চলছিল তখন সারা দেশ থেকে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের নিকট বহু অভিযোগ আসছিল দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে। যাদের নিয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে তারা বিতর্কিত। বিভিন্ন এলাকায় এরা মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করছেন। এসমস্ত বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে টাকা নিচ্ছে বা টাকা নেওয়ার দাবী করছে। ২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের মন্ত্রীসভার নিয়মিত বৈঠকের অনির্ধারিত আলোচনায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম ও অর্থ লেন-দেনের বিষয়গুলো তুলে ধরে সিনিয়র মন্ত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ ব্যপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে তারা বলেছেন, এতটাই অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে তাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অসহায় হয়ে পড়েছেন। এদিন মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রীসভার নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই নিয়ে সারাদেশে যে অরাজকতা ও অনিয়ম হচ্ছে সে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন মন্ত্রীসভার সিনিয়র সদস্যরা। এ দিন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বিমান মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ মন্ত্রীসভার সদস্যরা এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। সিনিয়র মন্ত্রীদের কথা ও ক্ষোভ শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিষয়টি আমি দেখবো। অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা, একটি স্বর্থান্বেষী কুচক্রি মহল সু-পরিকল্পিতভাবে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন উঠে পড়ে লেগেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে আমি “পাবনার নাজিরপুরে গণহত্যার ৫১ বছরে স্বীকৃতি মেলে নি শহীদ পরিবারের” শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেছি যা দেশের অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।
সুত্রমতে জানাগেছে, পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট-সনদ বাতিল ও ভাতা বন্ধের প্রতিবাদসহ ৭ দফা দাবিতে পাবনায় আন্দোলনরত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার বীর মুক্তিযোদ্ধা এড. শামসুল হক টুকু এম.পি।
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর পাবনা পৌর এলাকার নয়নামতির সোহাগী-সামাদ এতিম খানার হাফেজ ছাত্রদের পাগড়ি প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির নেতৃবৃন্দ ৭ দফা দাবির একটি স্মারকলিপি তুলেদেন ডেপুটি স্পিকারের হাতে। এর আগে পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধারা ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা পাবনার কৃতি সন্তান ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এম.পি কে।
অনুষ্ঠানে পাবনায় মুক্তিযোদ্ধাদের চলমান সংকট নিয়ে শামসুল হক টুকু বলেছেন, শুধু পাবনায় নয়, বেড়া-সাঁথিয়াতেও এক সংক্ষুব্ধ প্রাপ্তি নিয়ে লড়াই চলছে; একটা ¯œায়ু যুদ্ধ চলছে। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি- এ সুযোগ (সংকট) সৃষ্টি করে দেয়া ঠিক হয়নি। এমন কে করেছে, কী করেছে এ নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাইনি।
এদিন সুবিধা বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেছেন, আমি মনে করি- ৫০ বছর আগে আমরা স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়েছি। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, পরবর্তীতে তারা মুক্তিযোদ্ধাকে অমুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সেই দ্বন্দ্বটি আমরা এখন পাবনা শহরেও দেখছি। কিন্তু এই বিষয়ে আলোচনা বেমানান হিসেবে দেখছি। আপনাদের (মুক্তিযোদ্ধা) প্রয়োজনীয় বিষয়টি আমাকে বলেছেন, স্মারকলিপি পেয়েছি। তিনি বলেন, এ সমস্যাটি আর বেশী দিন থাকবে না।
ইতিমধ্যে পাবনায় ৭ দফা দাবিতে সুবিধা বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে একাত্বতা ঘোষণা করেছেন জেলার ৯টি থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ইউনিট কমান্ডাররা। এ ছাড়াও পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের আঞ্চলিক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান বিশ্বাস এম.পি এবং পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স এম.পি আন্দোলনরত মুক্তিযোদ্ধাদের ৭ দফা দাবি সমর্থন করে একাত্বতা প্রকাশ করেছেন। ডিসেম্বর মাস বাঙ্গালী জাতীর জন্য বিজয়ের মাস। এ লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে, তখন জাতি হিসেবে আমরা মহান স্বাধীনতার ৫১তম বিজয় জয়ন্তী উদ্যাপন করবো।
পাবনার মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম বাবলু ও তার সহযোগীরা ১৯ নভেম্বর পাবনা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, “আমরা অভিযোগ উপস্থাপন করি তারা স্বব্যখ্যায়িত দাবিদার মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জামুকাতে অভিযোগ দায়ের করি মাত্র। এই প্রক্রিয়াতেই আমরা এযাবত সদর থানার ৫১ জন স্বব্যাখ্যায়িত দাবিদার মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট ও লাল মুক্তিবার্তা বাতিল করতে সক্ষম হয়েছি। সংবাদ সম্মেলনে তারা আরও বলেছেন, এটা পাবনা সদর থনার মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত নীরব প্রতিরোধের অংশ। তারা আরও বলেছেন, জামুকাতে আরও ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনানী চলমান। পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্ন এরকম উদ্ভট বক্তব্য দেবার সাহস মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম বাবলু পায় কোথা থেকে? অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রশ্ন রেখে বলেছেন, জামুকা কর্তৃপক্ষের সাথে মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম বাবলুর কোনো গোপন সম্পর্ক রয়েছে কীনা সে বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে তাঁরা দাবি করেন।
সূত্র মতে জানা গেছে, দুর্নীতিবাজ মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম বাবলু পাবনা জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি হিসেবে পাবনা সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে রয়েছে। সাইফুল আলম বাবলু তার প্রভাব খাটিয়ে ৭/৮ বছর ধরে পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জামুকায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ইতিমধ্যে অনেকের গেজেট-সনদ ও ভাতা বন্ধ করেছেন। এ সমস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধারা মহামান্য হাইকোটে রীট পিটিশন দায়ের করেছেন। অনেক রীট পিটিশন মামলায় শুনানি অন্তে বিজ্ঞ বিচারক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট-সনদ বাতিল আদেশ কেন বে-আইনি ঘোষণা করা হবে না- তার কারণ জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। এছাড়াও মহামান্য হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্ট এর আপীল বিভাগের রায় রয়েছে এমন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও জামুকা’য় অভিযোগ দিয়ে তাদের ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। জাতী হিসেবে আমরা বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল সময় অতিক্রম করছি। আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন সমূহ রক্ষা করা এখন সময়ের দাবী। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তির দ্রুত অবসান কামনা করছেন দেশের বিজ্ঞজনেরা।
লেখক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকার কর্মী।
আবদুল জব্বার
সদস্য, পাবনা প্রেসক্লাব