এবাদত আলী
বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিশুতোষ কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পাবনা শহরের রাধানগরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম উমেদ আলী মিয়া। মাতার নাম নেকজান নেছা। তিনি পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমী হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ১৭ বছর বয়সে চিত্র-শিল্পী হবার দুর্বার আকর্ষণে কলকাতার বৌ বাজারস্থিত ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমীতে ভর্তি হন। ৪ বছর ধরে তিনি আর্ট শিক্ষা করেন। তার শিশুদের জন্য রচিত প্রথম ছড়া ও কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। ঐ সময় থেকে তার লেখা কবিতা ও ছড়া ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গেজেট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
তার জীবনকালের প্রায় ৫০ বছরই তিনি সাহিত্য চর্চায় কাটিয়েছেন। কবি বন্দে আলী মিয়া ছিলেন শিশুদের কবি। কেমন করে শিশুদের মন লেখনির মাধমে আনন্দে ভরে তোলা যায় এটাই ছিলো তার মূলত সাধনা। বাস্তব ক্ষেত্রেও তিনি শিশু সুলভ মন নিয়েই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে প্রায়ই হাসি ঠাট্টা করতেন। তিনি ছিলেন প্রায় সকলেরই দাদু। তিনি কথা বলার সময় প্রায়ই ছড়া কাটতেন। শিশুদের জন্য রচিত “আমাদের গ্রাম” একটি অনবদ্য কবিতা- তিনি লিখেছেন: আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/ থাকি সেথা সবে মিলে/ নাহি কেহ পর। পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই/ এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
কবি বন্দেআলী মিয়া ছিলেন সরল প্রকৃতির। দাম্ভিকতা বা আত্মঅহংকার তার মাঝে ছিলোনা। শিশু সাহিত্যে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট পুরুষ্কার লাভ করেন। তার অধিকাংশ রচনা ছিলো শিশুদের উপযোগি করে লেখা। শিশুদের জন্য প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের জীবনীও তিনি লিখেছেন।
কবি বন্দেআলী মিয়ার সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য কাব্য গ্রন্থ ময়নামতির চর। ময়নামতির চর কাব্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন“ তোমার ময়নামতির চর কাব্য খানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবন যাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত ঘরের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছো এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছো। তোমার সুপরিচিতি প্রাদেশিক শব্দ গুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুন্ঠিত হওনি। তাতে করে কবিতা গুলি আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়া গাঁয়ের এমন নিকট স্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোন কবিতায় পেয়েছি বলে মনে পড়ছেনা। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছো বলে আমি মনে করি। ২৬ জুলাই,১৯৩২ ।’’
তার ৯ খানা কাব্য ১০ খানা উপন্যাস, ৩ খানা ছোট গল্প, ১১ খানা নাটক এবং সঙ্গীত ভিত্তিক ২ খানা রচনা রয়েছে। কবি বন্দে আলী মিয়ার শিশুতোষ রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রচনা হলো চোর জামাই, মৃগপরী, মেঘকুমারী, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা, তাজমহল, বোকা জামাই, সুন্দরবনের বিভীষিকা, চালাকি, ভুতের কান্ড, শিয়াল পন্ডিতের পাঠশালা, শঠে শাঠ্যাং, ছোটদের নজরুল, কায়কোবাদ প্রভৃতি। যার সংখ্যা প্রায় ৮৭টি। এ ছাড়া তার “জীবনের দিনগুলি’’ একটি বিশেষ রচনা। কবি বন্দে আলী মিয়া বেশি জাক জমক পছন্দ করতেন না। এমনকি তার লেখার জন্য ভাবুক মনে ভাবের অভাব হতোনা। তিনি যে কোন পরিবেশেই কবিতা লিখতেন। কবিতা ছিলো তার নিত্য সঙ্গি।
কবি বন্দে আলী মিয়া ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। তিনি মৃত্যুর পুর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত নিজের হাতে বাজার করেছেন। তিনি বহুদিন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচতে চেয়েছেন। তাই তিনি লিখেছেন
এবারে আমার শেষ হয়ে এলো
প্রবাসের দিন গুলি।
যাবার বেলায় বারে বারে হায়
মন ওঠে তবু দুলি।
১৯৭৮ সালে রাজশাহী হতে প্রকাশিত কবি বন্দেআলী মিয়া সংবর্ধনা সংখ্যায় প্রতিতীতে তার একটি কবিতা ছাপা হয়। তাতে তিনি লিখেছিলেন-
‘আর কোন দিন ফিরিবনা
আমি কভু তোমাদের মাঝে।
শোন কান পেতে
আমার ভূবনে বিদায়ের বাঁশী বাজে।’ বন্দে আলী মিয়া।
কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন আমাদের মাঝ থেকে চির দিনের জন্য হারিয়ে গেলেও তার সাধনার ফসল, জীবন বোধের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত ছড়া, কবিতা, গান আজো বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায় তার বাসভবন কবি কুঞ্জের পশ্চিম পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। চিরতরে কবি সেখানেই ঠাঁই করে নিয়েছেন। বেছে নিয়েছেন জীবন যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবার আনন্দলোকের পথ। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ: ২৬/০৬/২০২৫.