এবাদত আলী
১৯৬৬ সালের কথা। তখন আমরা পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র। এবার কলেজে ছুটিতে কয়েক বন্ধু মিলে নাটোর জেলার বড়াইগ্রামের সাঁতইল গ্রামে যাবো। আমাদের সহপাঠি ফরজ আলীর ছোট ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াত খাওয়া এবং সেই সঙ্গে আমাদের সহপাঠি এএসএম নজরুল ইসলাম রবি (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও ডিজি এফ আই এর সাবেক ডিজি) র খালু, বড়াইগ্রাম কৃষ্টপুরের চেয়ারম্যান আবুল সরকারের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া।
দিনক্ষণ ঠিক হলো। পাবনা-ঈশ্বরদীর যোগাযোগের ক্ষেত্রে পাকা রাস্তা থাকলেও দাশুড়িয়া হতে মুলাডুলি পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা। এই রাস্তায় একমাত্র গরু-মহিষের গাড়ি ছাড়া অন্য কোন যানবাহন চলাচলের তেমন কোন ব্যবস্থা ছিলোনা বল্লেই চলে। মাঝে মধ্যে দু একটা ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম কোন মতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতো। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে না গরুর গাড়ি না ঘোড়ার ওসব কিছুই মিল্লনা। তাই দাশুড়িয়া পর্যন্ত বাসে চড়ে যাবার পর সেখান হতে মুলাডুলি পর্যন্ত শ্রীচরণই একমাত্র ভরসা। আমরা কয়েকজন বন্ধু দলবদ্ধভাবে হেসে খেলে ইয়ারকি ফাজলামি করতে করতে মুলাডুলি পর্যন্ত এবং সেখান থেকে রাজাপুর বাজার পর্যন্ত গিয়ে সকলেই হয়রান। আর যেন এক কদমও পা চলতে চাইছেনা। কিন্তু উপায় কি। এখান থেকে আরো পাঁচ ছয় মাইল পথ যেতে হবে। রাজাপুর বাজারে পৌঁছে কিছু চিড়া মুড়ি কিনে খাওয়া হলো। টিউবওয়েল থেকে পানি পান এবং সেই সঙ্গে চোখে মুখে পানির ছিটা দেওয়া হলো। কিছুটা স্বস্তি ফিরে যেন এলো সকলের মাঝে।
এর মধ্যে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল। একটি ঘোড়ার গাড়ির কোচওয়ান একটি কড়ই গাছের নিচে তার গাড়িটি রেখে ঘোড়াকে বালতিতে করে ছোলা-ভুষি খাওয়াচ্ছে। কোচওয়ানকে সাঁতইল যাবার কথা বলায় সে জানায় যে, সে রিজার্ভ গাড়িতে বড়াইগ্রাম থানার দারোগাদের নিয়ে এসেছে। তারা একটি কেসের ইনকোয়ারি করছে। ইনকোয়ারি শেষ হলে তাদেরকে আবার থানায় নিয়ে যেতে হবে। তাই এই রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। আর তা হলো আমাদের মধ্যে নজরুলের চেহারা ছিলো খুবই ভালো। সে ছিলো দারুন সৌখিন। তার মাথায় আগে থেকেই একটি হ্যাটও ছিলো। তাই তাকে একজন ম্যাজিষ্ট্রেট পরিচয় দিয়ে ঘোড়ার গাড়ির কোচওয়ানকে বলা হলো। এই যে ভাই আমাদের স্যার সাঁতইল যাবেন, আপনাকে সাঁতইল যেতে হবে। কোচওয়ান বলে দেহেন আমি থানার দারোগাদের নিয়ে আইছি। তাদেরকে থানায় না পেঁছানোর আগে আমি কোন খ্যাপে যাবের পারবোলয়। আমাদের সহপাঠি সাত্তার বলে এই ব্যাটা তুই ম্যাজিষ্ট্রেটকে চিনিস। থানার দারোগাই বড়ো না ম্যাজিষ্ট্রেটই বড়ো। কোচওয়ান বলে দ্যাহেন ভাই ওম্বা কথা কয়েননা। থানার ষ্টাফ যহন আমাক ঠাপাবিনি তহনতো আর ম্যাষ্টেট মানবিনানে। আমাক মাইরে ফেলালিও আমি যাতি পারবোনানে। আমরাও নাছোড় বান্দা তাকে একরকম জোর করেই রাজি করালাম। ঠিক আছে যদি থানার ষ্টাফ তোমাকে জিজ্ঞাসা করে তখন ম্যাজিষ্ট্রেট স্যারের কথা বলবে। তা যদি না শোনে তাহলে এর জন্য আমরা দায়ি। আমরা সাঁতইল ফরজ সাহেবের বাড়ি যাবো। সেখানে আমরা দু তিন দিন থাকবো। তোমার কোন অসুবিধা হলে। তুমি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাছে চলে যাবে দেখবে দারোগার কি দশা করি।
যাক নিরূপায় হয়ে গাড়ির কোচওয়ান অগত্যা রাজি হলো। আমরা তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে উঠে ওকে জোরে চালাতে বল্লাম। আমরা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রায় মাইল খনেক যাবার পরই একে অপরের সঙ্গে ইয়ারকি ফাজলামি শুরু করে দিলাম। আমাদের অভ্যাসমত ‘পাবনা বিড়ি’ টানা শুরু করলাম। একে অপরের নাম ধরে ডাকাডাকি এবং হাসাহাসি করতে থাকি। ঘোড়ার গাড়ির কোচওয়ান বার বার পিছন ফিরে তাকায় সেতো অবাক? এইকি সেই সাহেব যাদেরকে আমি নিয়ে চলেছি? তিনি একসময় বলেই বসলেন আপনারা কেমন সাহেব? বিড়ি টানা সাহেব না মা’টে সাহেব।
এক সময় আমরা সাঁতইল গ্রামে ফরজরআলীর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া চুকে দিয়ে কোচওয়ানকে আবার বলা হলো থানার দারোগা তোমার কোন অসুবিধা করলে আমাদের এখানে চলে আসবে। সে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো।
যাক,আমাদের থাকার জন্য আগে থেকেই পৃথক একটি ঘর বরাদ্দ করা ছিলো। কল তলায় গিয়ে সকলেই হাত মুখ ধুয়ে ঘরে বসতেই নানান ধরনের নাস্তার ব্যবস্থা। আমরা সকলে মিলে নাস্তা খেয়ে ছোট একটা ঘুম দিয়ে নিলাম। ঘুম থেকে উঠে এপাড়া ওপাড়া কিছুটা বেড়িয়ে নেয়া হলো। হৈ হুল্লোড় করে বিয়ে বাড়িতে অবস্থান করতে লাগলাম।
পরের দিন এলাকার রীতি অনুসারে বিকাল বেলা বিয়ের গাড়ি রওনা হলো। বিয়ের গাড়ি মানে গোটা তিরিশেক মহিষের গাড়ি। মহিষের গাড়িতে প্রথমে ধানের খড় বিছিয়ে তার উপর নকসি কাঁথা বিছানো। আমরা একটি গাড়িতে গিয়ে বসলাম। সাঁতইল থেকে বিয়ে বাড়ির দুরত্ব প্রায় ছয় মাইল। এই পথ কোন রাস্তা নয়। ধানের জমি দিয়ে যাওয়া। সবেমাত্র ধান কাটা হয়েছে। সমতল জমি। পাল্লা দিয়ে মহিষের গাড়ি রওনা দিলো। কার গাড়ি আগে যাবে তারই প্রতিযোগিতা প্রত্যেক মহিশের গলায় বড়সড় আকারের ঘন্টা বাঁধা।ঘন্টার শব্দ এবং গাড়োয়ানের হাঁক ডাকে গাড়িতে যারা আমরা বরযাত্রি ছিলাম তাদের দফা রফা হবার যোগাড়। গাড়ির ঝাঁকুনিতে যেন পেটের নাড়ি ভুড়ি বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু উপায় কি। কে শোনে কার কথা? গাড়োয়ানরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে। টিকে থাকতে না পারলে যে সন্মানের প্রশ্ন। কি আর করা। আমরাও হৈ হে রৈ রৈ করতে করতে চল্লাম। কথায় বলে ‘যেখানকার যে ভাও উল্টা করে বয়ো নাও।’ আমরা তাই ঐ এলাকার বরযাত্রিদের সঙ্গে মিশে গেলাম। সারা পথ নারায়ে তকবির- আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিতে দিতে একসময় বিয়ে বাড়িতে পৌঁছানো হলো। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।