আটঘরিয়ায়……… সাংবাদিকদের মিলন মেলায় এক দিন

–এবাদত আলী
বৈশাখ মাসের শেষপ্রান্তে অর্থাৎ ২৪ শে বৈশাখ-১৪৩২, প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করেই শোভাযাত্রায় শরীক হতে হলো। বয়সের ভার কিছুটা বাধাগ্রস্ত করতে চাইলেও আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি খাইরুল ইসলাম বাসিদ, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ও অন্যান্য সদস্য সাংবাদিক বন্ধুদের অনুরোধ উপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হলোনা। তাই সেদিন ৭ মে -২০২৫, আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের ৪৭ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে দিনব্যাপি বিভিন্ন কর্মসুচি যেমন প্রেসক্লাবের বর্ষপুর্তি উদযাপনের জন্য শোভাযাত্রা, কেক কাটা, শুভেচ্ছা বিনিময়, আলোচনা সভা ও মধ্যাহ্ন ভোজ ইত্যাদি। এই প্রেসক্লাবের সাথে আমার ( এই প্রতিবেদকের) অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক যা না বল্লেই নয়। কারণ ১৯৭৮ সালের এমনি একটি দিনে আমরা মাত্র কয়েকজন মিলে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের গোড়া পত্তন করেছিলাম। সে এক মজার ইতিহাস।
চন্দ্রাবতী,চিকনাই ও রতœাই নদীর পলি বিধৌত জনপদ পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলা। এই উপজেলায় একটি প্রেসক্লাব গঠনের কথা সর্বপ্রথম উত্থাপন করেন আটঘরিয়ার কৃতি সন্তান আমিরুল ইসলাম রাঙা। রাঙা একদিন এবাদত আলীকে (এই প্রতিবেদককে) আটঘরিয়া প্রেস ক্লাব গঠনের প্রস্তাব দেন। এবাদত আলী লেখালেখির সাথে আগে থেকেই যুক্ত ছিলেন এবং আমিরুল ইসলাম রাঙা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরে পাবনা থেকে সাপ্তাহিক ইছামতি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এ ছাড়া দেবোত্তরের আবদুস সাত্তার মিয়া ও লেখা লেখির সাথে যুক্ত ছিলেন। তাই তাঁর সাথেও আলাপ হলো প্রেস ক্লাব গঠনের বিষয় নিয়ে। এই তিন জন মিলে সিদ্ধান্ত হয় আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের। আরো কথা হয় আটঘরিয়া পশু হাসপাতালের তৎকালীন পশু চিকিৎসক মোঃ আবদুল কাদেরের বড় ছেলে সিরাজুদ দাহার (এস দাহার) মাতলুর সাথে। তাই তাঁরা সকলে মিলে দেবোত্তর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বসে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেন। পরে দেবোত্তর বাজারের এক মাত্র চায়ের দোকান অর্থাৎ মজিবর রহমান ঠান্ডার চায়ের দোকানে বসে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ হয়।
১৯৭৮ সালের ৭ মে তারিখে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের নবযাত্রা শুরু হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এবাদত আলী সভাপতি, আবদুস সাত্তার মিয়া সাধারণ সম্পাদক এবং আমিরুল ইসলাম রাঙা ও এস দাহার মাতলু সদস্য হন। এর পর আরো চারজনকে ,যেমন আটঘরিয়ার বেরুয়ানের হাসান আলী, কয়রাবাড়ির মোহাম্মদ ইয়াছিন, পাবনা সদরের মনোহরপুরের এইচ কেএম আবু বকর সিদ্দিক ও আটঘরিয়ার চাঁদপুরের মোসলেম উদ্দিনকে সদস্য করা হয়। পরবর্তীকালে অনেকেই এই প্রেসক্লাবের সদস্য পদ লাভ করেন।
মজিবর রহমান ঠান্ডার চায়ের দোকানে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠন করা হলো কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য বসার কোন ব্যবস্থা হলোনা। ঠান্ডার দোকানের উত্তর পাশে কিছুটা ফাঁকা জায়গা পড়ে ছিলো। আমরা প্রস্তাব দিতেই তিনি সেখানে ঢেউ টিনের একটি ছাপড়া ঘর তৈরি করে দিলেন। নামমাত্র ভাড়ায় আমরা সেখানে প্রেসক্লাবের জন্য অফিস ঘর বানালাম। কিন্তু চেয়ার-টেবিল পাবো কোথায়? সকলে মিলে চাঁদা-হারি তুলে ৭৫ টাকা দরে খান কয়েক চেয়ার এবং ১০০ টাকা দরে দুটো টেবিল ক্রয় করে বসার এবং খাতাপত্র রাখার ব্যবস্থা করা হলো। পাটখড়ির বেড়া দেওয়া জানালা বিহীন ভাড়া ঘরে বসেই সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার বিষয় নিয়ে প্রতিদিন বিকালে আমরা আলাপ আলোচনায় মত্ত হতাম।
প্রেসক্লাব গঠনের পরপরই এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। গন্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেন। বিশেষ করে দেবোত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার মোল্লা, দেবোত্তরের সৈয়দ নাসিরুজ্জামান, রাধাকান্তপুরের জাহাঙ্গীর আলম ঘুটু প্রমুখ ব্যক্তিগণ প্রেসক্লাবের ব্যাপারে দারুনভাবে উৎসাহি হওয়ায় আমরা চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার মোল্লাকে প্রধান উপদেষ্টা এবং সৈয়দ নাসিরুজ্জামান ও জাহাঙ্গীর আলম ঘুটুকে সদস্য করে একটি উপদেষ্টা পরিষদও গঠন করি। প্রেসক্লাব গঠনের পরপরই অর্থাৎ ১৭ মে, ১৯৭৮ তারিখে রাষ্ট্রপতি লেঃ জেঃ জিয়াউর রহমান আটঘরিয়া কলেজে আগমণ করবেন এবং কলেজ মাঠে জনসভায় ভাষণ দিবেন। আটঘরিয়ার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ মোতাবেক আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের পক্ষ হতে প্রেসক্লাবের সভাপতি উক্ত জনসভায় বক্তব্য রেখে রাষ্ট্রপতিকে আটঘরিয়াবাসির অভাব অভিযোগ নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি আটঘরিয়া প্রেসক্লাব সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।
এ ভাবেই হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে চলে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের কার্যক্রম। কিন্তু একেবারে বেমানান হলেও সত্য যে, দীর্ঘ ২২ বছর এই প্রেসক্লাবের নিজস্ব কোন জায়গা বা ঘর-দরজা ছিলনা। কখনো বা মৌখিক অনুমতি নিয়ে কখনো বা ভাড়া ঘরে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের কার্যক্রম চালানো হতো। এরই মাঝে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠালগ্নে ও পরবতীতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্য ক্লাবের ২২ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবাদত আলী, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তার মিয়া, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আমিরুল ইসলাম রাঙা, কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ ইয়াছিন, মো: হাসান আলী ও এইচকেএম আবু বকর সিদ্দিককে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য পদ প্রদান করা হয়। একথা আজ আনন্দের সাথেই বলতে হয় যে, ২০০১ সালে আটঘরিয়া উপজেলার তদানিন্তন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক উদ্দিন অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং উদারতার সাথে সাংবাদিকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উপজেলা পরিষদের প্রস্তাবিত স্মৃতিসৌধের পাশে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেন। শুধু তাই নয় উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে মাটি ভরাটের ও ব্যবস্থা করেন তিনি।
পরবর্তীকালে পাবনার কৃতি সন্তান, বিআইডাব্লি¬উটিসির সাবেক চেয়ারম্যান শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ২০০৬ সালে আর্থিক সহায়তা দান করলে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের নিজস্ব ভবন নির্মিত হয়।

যাক এই প্রেসক্লাবেরই আজ ৪৭ বছর পুর্তি উপলক্ষে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে হলো। আর এই শোভাযাত্রার শ্রীবৃদ্ধি হলো অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আটঘরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিনহাজুল ইসলামের আগ্রহের কারণে। তিনি প্রেসক্লাবে উপস্থিত হতেই সকলকেই আটঘরিয়া প্রেসক্লাব লোগো সম্বলিত একটি করে গেঞ্জি পরতে দেয়া হলো। আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের ৪৭ তম বছর পুর্তি উৎসব সম্বলিত গেঞ্জি পরে তখন প্রেসক্লাবের সদস্যের মধ্যে প্রায় সকল সদস্যসহ বিশেষ অতিথি বৃন্দ ও এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তি বর্গ অংশগ্রহণ করেন। সকাল সাড়ে দশটার দিকে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে এক বর্ণ্যাঢ্য র‌্যালী বের হয় এবং দেবোত্তর বাজারের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে প্রেসক্লাবে গিয়ে শেষ হয়। এরপর আলোচনা সভা ও কেক কাটা।
প্রেসক্লাবের ঘরে সীমিত পরিসরে বলতে গেলে ব্যাপক আয়োজন। আনন্দঘন পরিবেশে অতিথিগণসহ কেক কাটা পর্ব সমাধার পর আলোচনাসভা। আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি খাইরুল ইসলাম বাসিদের সভাপতিত্বে ও প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের উপস্থাপনায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের পর প্রানবন্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন আটঘরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিনহাজুল ইসলাম। বিশেষ অতিথিবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য দেন আটঘরিয়াউপজেলা স্বাস্থ্য ও প. প. কর্মকর্তা ডাঃ আব্দুল্লাহ আল আজিজ, আটঘরিয়া থানার অফিসার ইন চার্জ ওসি শফিকুজ্জামান সরকার। এসময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল হালিম, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী কর্মকর্তা একরামুল বারি, আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, মোফাজ্জল হোসন, যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুল ইমলাম, অর্থ সম্পাদক শফিউল্লাহ শফি, কার্য নির্বাহী সদস্য মোঃশহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবাদত আলী, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক আব্দুস সাত্তার মিয়া, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি নাট্যকার ও সাংবাদিক এইচ কে এম আবু বকর সিদ্দিক, পাবনরা প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি এসএম আলাউদ্দিন, আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি মাওলানা আমিরুল ইসলাম, আটঘরিয়া উপজেলা বি এন পির সদস্য সচিব মনোয়ার হোসেন আলম, উপজেলা জামাতের আমির মাওলানা নকিবুল্লাহ, পৌর বিএনপির সভাপতি আজাহার আলী খান প্রমুখ। আপলোচনা শেষে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন। এরই মধ্য দিয়ে মিলন মেলার যবনিকাপাত ঘটে। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী