(পুর্ব প্রকাশের পর )
এবাদত আলী
খবরের কাগজে সাংবাদিকতা করা কিংবা তাতে লেখালেখি করার আরেকটি কারণ ছিলো তাহলো আমি বাল্যকাল থেকেই গল্প-কবিতা লিখতাম। আর লেখার নেশাটা এমনিভাবেই পেয়ে বসেছিলো যে, কারো নিষেধ শুনতামনা। গল্প- কবিতা লিখতে গিয়ে আমার লেখা-পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে আমার অভিভাবকরা শংকিত হলেও সেদিকে আমি কর্ণপাত করতামনা। আর যখন পাবনা রাধানগর মজুমদার একাডেমীতে (আর এম একাডেমী) দশম শ্রেণীতে পড়ি তখন একাডেমীর ছাত্রদের মধ্য থেকে আমি বার্ষিকী সম্পাদক নির্বাচিত হই এবং আমার সম্পাদনায় আর এম একাডেমী হতে সর্বপ্রথম স্কুল বার্ষিকী বের করা হয়। আরএম একাডেমীর ইংরেজি শিক্ষক জহুরুল হকের তত্বাবধানে ১৯৬৭ সালে এই বার্ষিকী প্রকাশিত হয়। বার্ষিকীতে আমার লেখা রম্য রচনা “হায়না” তখন পাঠক মহলে দরুন উপভোগ্য হয় ফলে আমার পরিচিতি অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়। যার ফলশ্রুতিতে আমার সহপাঠি বন্ধু আব্দুস সাত্তার সহ আবুল কাসেম মৃধা, এবি সিদ্দিক হোসেন এবং আরো অনেকে মিলে পাবনা থেকে “দিগন্তিকা” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশে সচেষ্ট হই। গঠন করা হয় দিগন্তিকা সম্পাদনা পরিষদ। এই পরিষদের সভাপতি হন রাজশাহী ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যাপক মুহম্মদ হাবিবুন নবী। সহ-সভাপতি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র সৈয়দ আব্দুল হাই বিজু, প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন, কলেজের অধ্যাপক মুহম্মদ ইদরিস আলী। পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মুহম্মদ আব্দুস সাত্তার (ভাঙ্গুড়া হাজী জামাল উদ্দিন কলেজের সাবেক অধ্যাপক) এবং আমাকে (এবাদত আলীকে) সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। দিগন্তিকা পত্রিকায় যাঁরা লিখতেন তাঁরা হলেন, অধ্যাপিকা ফিরোজা বেগম, অধ্যাপক কামরুজ্জামান, অধ্যাপক একেএম হাসানুজ্জামান, অধ্যাপক হাবিবুুন্নবী, অধ্যাপক ইদরিস আলী, অধ্যাপক আব্দুল হামিদ টিকে, আরো যাঁরা লিখতেন তাঁরা হলেন, মনোয়ার হোসেন জাহেদী, সামসুর রহমান, সোরহাব হোসেন খান, সৈয়দ আব্দুল হাই বিজু, এবি সিদ্দিক, এবাদত আলী, আবু দাউদ, ফরিদা বেগম, সৈয়দ ফয়জুল হাসান, কুদ্দুস হাসান ফজলে, আখতারুজআমান, আবুল কাসেম মৃধা প্রমুখ। দিগন্তিকা পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় শিশুতোষ কবি বন্দে আলী মিয়া আর্শীবাণী লিখেছিলেন, তিনি লিখেছিলেন, ‘‘নতুন পথের নবীন পথিক/ তোমার দিগন্তিকা/ খ্যাতির মাল্য কন্ঠে পরাবে/ ভালে দেবে জয়টিকা।’’
এসময় পাবনা থেকে “ আমাদের দেশ” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক ‘চলনবিলের ইতি কথা’র লেখক আব্দুল হামিদ টিকে। আমার দেশ একই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি থেকে উর্দু ভাষায় “হামারা ওয়াতন” এবং লন্ডন থেকে ইংরেজি ভাষায় “ আওয়ার হোম” নামে প্রকাশিত হতো। পত্রিকার সম্পাদক হামিদ স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করে আমি ওই পত্রিকায় লেখা ছাপানোর জন্য অনুরোধ করলে তিনি শুধু লেখাই নয় সেই সাথে গুরুতপূর্ণ খবরাখবরও পাঠাতে বলেন। স্যারের কথায় খবর লেখার অনুপ্রেরণা লাভ করি। কিন্তু পত্রিকায় খবর লেখার কলাকৌশল সম্পর্কে তখন আমার নুন্যতম ধারণাটুকুর ও জন্ম হয়নি। তাই একাকি ভাবতে থাকি কিভাবে খবর লেখা যায়।
এর কিছু দিন পর আমি জায়গির বাড়ি হতে নিজ বাড়ি যাবার পথে ঘরনাগড়া গ্রামের লোকদের নিকট জানতে পারি যে, এলাকার আখ ক্ষেতের আখ শেয়ালে কামড়িয়ে রস চুষে নিয়ে দারুন ক্ষতি করছে। আমি এই ঘটনা সাজিয়ে গুছিয়ে একটি খবর লিখে স্যারের নিকট নিয়ে যাই। হামিদ স্যার একটু মৃদু হেসে আমার লেখা খবর শুধরে দিলেন। অর্থাৎ আমি লিখেছিলাম, পাবনা সদর মহকুমার ঘরনাগড়া গ্রামের হাজার হাজার বিঘার আখ শিয়ালে কামড়াইয়া খাইয়া ফেলিতেছে। শিয়াল কর্তৃক আখ খাইয়া ফেলায় কৃষকেরা দিশাহারা হইয়া পড়িতেছে। তাহারা কি করিবে তাহা কিছুই ভাবিয়া ঠাহর করিতে পারিতেছেনা। এলাকার শিয়ালগণ দল বাঁধিয়া একজোট হইয়া আখ ক্ষেতের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আখ কামড়াইয়া কামড়াইয়া রস চুষিয়া লওয়ায় আখের গাছ শুকাইয়া মরিয়া যাইতেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি আমার সামনেই খবরটি শুধরিয়ে দিলে আমি তখন বুঝতে পারি যে, আমার লেখায় বহু সংখ্যক ভুল রয়েছে। আমি বুঝতে পারি যে, হাজার হাজার বিঘার আখ নয় সেখানে হাজার হাজার বিঘা জমির আখ হবে। শিয়াল আখ খেয়ে ফেলতে পারেনা। শুধু রস চুষে নেয়। এলাকার শিয়ালগণ দল বাধিয়া শব্দটি ভুল কারণ এলাকার শিয়াল না হয়ে ভিন্ন এলাকার শিয়ালও তো হতে পারে। এছাড়া যখন লেখা হয়েছে দল বেঁধে তখন আর একজোট হয়ে লেখার কোন প্রয়োজন ছিলোনা। এমনি ভুলের জন্য আমি নিজে নিজে লজ্জা পাই। তখন লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে। এমনি একটি ঘটনার অবতারনা হয়েছিলো আমার সহপাঠির কাছে আমার লেখা কবিতা দেখাতে নিয়ে গিয়ে। আমার লেখা ছড়া ও কবিতা গুলো একদিন আমার সহপাঠি বন্ধূ আবু সাইদ মোঃ নজরুলের কাছে নিয়ে গেলাম। ওর ডাক নাম রবি। ভারত উপমহাদেশের দু জন খ্যাতিমান কবির নামেই ওর বাবা ওর নাম রেখেছিলেন। চেহারা সুরতে কবিত্ব ভাব থাকলেও ওর ভিতরটা ছিলো চাপা। তা বলে সে কোন দিন আমাকে নিরুৎসাহিত করেনি, বরং আমাকে বরাবর উৎসাহই যুগিয়েছে। যাক তার কাছে ছড়া ও কবিতার খাতা নিয়ে গেলে সে আমাকে এক কবির গল্প শোনালো। এক কবি,“ কপাল ভিজিয়া গেল – দু নয়নের জলে” এমনি ধরনের কবিতার লাইন লিখে নিয়ে জনৈক প্রতিষ্ঠিত কবির নিকট দেখাতে নিয়ে গেলে কবি ভাবলেন এর উৎসাহ নষ্ট করা ঠিক হবেনা। তাই তিনি পরবর্তী দু লাইন লিখে দিলে কবিতাটি দাঁড়ায়—-
কপাল ভিজিয়া গেল
দু নয়নের জলে
কবিকে উবদা করে ঝুলাও
আম্র গাছের ডালে।
অর্থাৎ দু চোখের পানিতে কপাল ভিজাতে গেলে কবিকে উবদা করে গাছে ঝুলানো ছাড়া আর কিইবা করার থাকতে পারে! প্রকৃত পক্ষে কপালের পরিবর্তে কপোল লিখলেই কেবল গন্ড বেয়ে দু নয়নের জল পড়তো। বন্ধুর ওমন কথা শুনে আমার দারুন লজ্জাবোধ হলো। নিশ্চয়ই আমার শব্দ চয়নেও এ ধরনের গোলযোগ রয়েছে। তাই দেরি না করে রাজশেখর বসুর চলন্তিকা ডিকশনারি কিনে ফেললাম।(ক্রমশ:)
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ:- ২১/০৪/২০২৫.