সাংবাদিকতার সাড়ে তিন যুগ (পূর্ব প্রকাশের পর)(একুশ)

  

আশির দশকের প্রথম দিকে ‘ময়না তদন্তের বিড়ম্বনা’ নামক একটি নিবন্ধ যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্ফুলিঙ্গ পত্রিকায় সপ্রতিভের কলাম নামক কলামে প্রকাশ পায় যা পাঠকবৃন্দের কাছে তুলে ধরা হলো।
বেশ ক’বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘চারুপাঠ’ নামক একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। উক্ত অন্ষ্ঠুানের উপস্থাপক অব্দুল্লাহ আবু সাঈদ একজন মানুষের দেহের মূল্য সম্পর্কে একটি চমৎকার তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। মানুষের দেহে যেসকল উপাদান রয়েছে যেমন তাপ, পানি, ক্যালসিয়াম বা চুন, ফসফরাস, লবন, কার্বন ও লোহা ইত্যাদির মূল্য নির্ণয় করে তিনি একজন মানুষের দেহের মূল্য তৎকালীন বাজার মূল্য অনুসারে মাত্র ৬হাজার ১শ ২৪ টাকা ২৭ পয়সা দেখিয়েছিলেন। প্রতিটি উপাদানের পরিমাণ এবং তার বাজার মূল্য পৃথক পৃথক ভাবে দেখানো হয়েছিলো।
যেমন একজন মানুষের শরীরে যে লোহা রয়েছে তা দুটো প্যারেকের সমান। তিনি সেটুকুর মূল্যও ধরেছিলেন। তবে ঐ মূল্যের মধ্যে পানির দাম বাদ রাখা হয়েছিলো। মানুষের দেহে যে পরিমাণ পানি থাকে বা একজন মানুষ বেঁচে থাকার জন্য তার শরীরে যে পরিমাণ পানি থাকার প্রয়োজন তার দাম ধরলে আরো দু’এক টাকা হয়তো বৃদ্ধি পেতো। কিন্তু একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার দেহের মূল্যমান কত টাকায় দাঁড়ায় তা তিনি উল্লেখ করেন নি।
আসলে একজন মানুষ মৃত্যবরণ করলে তার সে দামটুকুও আর অবশিষ্ট থাকেনা বলেই মনে হয়। আর কোন মানুষ যদি কারো হাতে নিহত হয়, যেকোন দুর্ঘটনায় বা অসাভাবিকভাবে মৃত্যু বরণ করে তাহলে তার দেহের মূল্য নির্ণয় তো দুরের কথা তার মরদেহ নিয়ে যে কি ধরণের টানা-হেঁচড়া শুরু হয়ে যায় তা বর্ণনা করাই কঠিন।
কোন ব্যক্তি যদি কারো হাতে নিহত হয়, কেউ যদি গলায় রশি নিয়ে, বিষ পান করে, মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে, চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে কিংবা পানিতে ডুবে, গাছ থেকে পড়ে বা যেকোন দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করে তাহলে সে মৃত্যকে বলা হয় আননেচারাল ডেথ বা অস্বাভাবিক মৃত্যু। দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে ঐসকল মৃত ব্যক্তির দেহ পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে লাশকাটা ঘর বা মর্গে নিয়ে লাশের ময়না তদন্ত করা হয়। যে এলাকায় এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সে এলাকার থানায় লিখিতভাবে আবেদন জানানোর পর কিংবা কোন সুত্রে খবর পাওয়ার পর থানায় একটি জিডি এন্ট্রি করা হয়্ অতঃপর একজন পুলিশ অফিসার তার সঙ্গিসহ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশের (মৃতব্যক্তির) সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন। হত্যা বা আত্ম হত্যার আলামত জব্দ করণসহ স্বাক্ষ্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করেন। এরপর শুরু হয় লাশ নিয়ে বিড়ম্বনা। কোন শরিফ আদমি কিংবা শহর ও শহরতলির লাশ হলে তেমন কোন অসুবিধা হয়না। কিন্তু নিভৃত পল্লী অঞ্চলের লাশ হলেই সমস্যা বেশি করে দেখা দেয়।
এদেশে এখনো মৃতদেহ সযতনে বহনের জন্য বডি ব্যাগের প্রচলন না থাকায় ডেডবডি বা মরদেহ মর্গে নেয়ার জন্য আনো খেজুরের পাটি (মাদুর)। আনো তক্তা। জোগাড় করো রশি। মরা মানুষটাকে একটি তক্তার উপর শুইয়ে দিয়ে খেজুরের পাটি দিয়ে জড়িয়ে রশি দ্বারা আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে নিউজপ্রিন্টের রোলের মত করে অতি মন্থর গতির যেকোন বাহনে চড়িয়ে দেয়া হয়। গরু-মহিষের গাড়ির মালকোচা মারা গাড়োয়ান, নৌকার কফনি পরা মাঝি-মাল্ল অথবা ফরজ তরক করে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে রিকসা-ভ্যানের চালক বিড়ি-সিগারেট ফুকতে ফুকতে লাশ নিয়ে মর্গ বা লাশকাটা ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। লাশের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ কনষ্টেবল লাশের দুর্গন্ধ এড়ানোর ভয়ে বাতাসের উজান ভাটি দেখে লাশ পাহারা দিয়ে নিয়ে যায়। মৃত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ জনেরা শোকে মুহ্যমান থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিবেশি বা নিকট আত্মীয় স্বজন সঙ্গে যায় বটে তবে তাদের ওজু গোসলের বালাই থাকেনা বললেই চলে। অজ পাড়াগাঁ থেকে এমনিভাবে অধিক দুরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত লাশকাটা ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে লাশ ফুলে ফেঁপে দফা রফা হবার জোগাড়।

জেলা শহরের আশে পাশে কোন একটি বিরান এলাকায় নির্মিত এক দরজা বিশিষ্ট লাশ কাটা ঘর। ঐ ঘরের মেঝেতে একটি টেবিলের উপর মরা মানুষটিকে কোনমতে শুইয়ে দিতে পারলেই হলো। এরপর শুরু হয় প্রহর গণনার পালা। সময় মত লাশ মর্গে পৌঁছতে না পারলে পোষ্টমর্টেমের ডাক্তার মেলা দায়। হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের মত মর্গ এলাকায় যখন ইচ্ছা তখুনি ডাক্তার পাওয়া যায়না। তাই বিকাল বেলা কোন কোন মরদেহ লাশ কাটা ঘরে নিয়ে গেলে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন রাতের আঁধার ঘনিভূত হতে থাকে লাশ কাটা ঘরের হেফাজতকারি ডোম বাবুরা তখন মর্গের ঘরে তালা লাগিয়ে অনত্র চলে যায়। লাশের সঙ্গে আসা আত্মীয় স্বজনদের যে কি দুরবস্থা ঘটে তা ভ্ক্তুভোগি ছাড়া এ বিষয় হৃদয়ঙ্গম করার সাধ্য কারো আছে বলে মনে হয়না।
আননেচারাল ডেথ বা অস্বাভাবিক মৃত্যু যাদের কপালে জোটে তারা নিজেরাও মরে তাদের আত্মীয় স্বজনদেরকেও হয়রান পেরেশান করে মারে। পরদিন সকালে ময়না তদন্ত শেষে ফুলে-ফেপে ওঠা দুর্গন্ধযুক্ত লাশ একই বাহনে ফিরে যায় আপন গন্তব্যে। এছাড়া বেওয়ারিশ লাশের ময়না তদন্ত কিংবা বদ নসিবের কারণে যেসকল লাশের ডবল রিডবল পোষ্টমর্টেমের প্রয়োজন পড়ে সেক্ষেত্রে যে কি নিদারুন দুর্গতি ঘটে তা না বলাই শ্রেয়।
জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধনই যখন রাষ্ট্রের মুল উদ্দেশ্য তখন একজন অস্বাভাবিক অবস্থায় মৃত ব্যক্তির শেষ কল্যাণ টুকু করার কোন সহজতর পন্থা অবলম্বন করা হয়না কেন? এক্ষেত্রে লাশের ময়না তদন্ত কাজের দ্রæত সহায়তার জন্য প্রতিটি জেলা সদরে একটি লাশ বহনের গাড়ির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যে থানার অধীনে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে সেই থানা থেকে ওয়ারলেস, টেলিফোন বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লাশ বহনের গাড়ি কল করে লাশ মর্গে নিয়ে ময়না তদন্ত শেষে পুনরায় তা যথাস্থানে পৌঁছে দিবার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস কিংবা অন্য েেকান প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অপর দিকে প্রতিটি থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, শিশু ও মাতৃসদন কেন্দ্রে, পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে কিংবা প্রতি দু’টি থানা মিলে সুবিধা মত একটি স্থানে লাশকাটা ঘর নির্মাণ করা। এদিকে জেলা সদরে একটি করে ভ্রাম্যমান ময়না তদন্ত টিম গঠন পুর্বক সংশ্লিষ্ট থানা এলাকা থেকে খবর পাওয়ার পর টিমের ডাক্তারগণ কর্তৃক উক্ত লাশকাটা ঘরে পৌঁছে ময়না তদন্তের কাজ সমাধা করা ইত্যাদি।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষ উল্লিখিত বিষয়গুলো ভেবে চিন্তে সে মোতাবেক সহজতর পদ্ধতিতে ময়না তদন্ত পর্ব সমাধা করলে মরা মানুষের ময়না তদন্ত করাতে গিয়ে জীবিত মানুষদের বিড়ম্বনা অনেকাংশেই লাঘব হবে বলে আমার বিশ্বাস। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।