সর্ব গুণ প্রত্যক্ষ ভাবে সকল মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না । প্রসুপ্তভাবে থাকলেও বিভিন্ন প্রতিকুল অবস্থা বা আনুকুল্যের অভাবে তা প্রকাশ পায় না। গুণের কদর সর্বত্র। গুণহীনের কোথাও না। ‘গুণ’ আর ‘জ্ঞান’ পরিপূরক। জ্ঞানীই গুণান্বিত। এ লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় এক গুণান্বিতা বিদূষীর সৃৃজনশীল শিল্প কর্ম এবং শিক্ষাবিদ ও সমাজবিদের ভূমিকায় অবতীর্ণতা নিয়ে। এক সময়ে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদে, পরবর্তীতে মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ, শেষে ইস্পাহানি স্কুল এন্ড কলেজ, ঢাকায় অধ্যক্ষ পদে নিয়োজিতা ছিলেন যিনি। তিনি আবাল্য মাতৃবোধ সমন্বিতা ডঃ মারুফী খান। ঘটনা পরম্পরায় পারিবারিক এবং আত্মিক বন্ধনে তিনি আজ অতি আপনার থেকে আপনার। সে সুবাদে তাঁর মহত্তম জীবন সম্বন্ধে জানারও সুযোগ হয়।
তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, সমাজবিদ, শিল্পগুণসম্পন্না, সৃজনশীলা। সরকারের সেবা মন্ত্রকে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। শিক্ষকতা পেশায়ও তথৈবচ। অনেক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত-শিক্ষিতারা অনেক বড় বড় পদে আজ অধিষ্ঠিত- যারা উনার ছাত্র-ছাত্রী এবং দেশ সেবায় নিয়োজিত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে একটি নন-গভর্ণমেন্ট অর্গানাইজেশনের পরিচালক। আর্ত-পীড়িতদের সেবা করা যার কাজ। খ্যাতনামা সুলেখিকাও তিনি। গর্ভবতী মা ও শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণে তাঁরই অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি হস্পিটাল স্থাপন। যার সেবা কাজ নিরন্তরভাবে চলমান। এতো কিছুর পরও গৃহে বসে বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি রক্ষার উপকরণ পিঠা, পায়েস তৈরী, রন্ধন শিল্পে সুনিপুণা এ বিদূষী। আপন মাধুরী মিশিয়ে তিনি এগুলোর স্রষ্টা। সেলাই কাজে সিদ্ধ হস্তা। বয়সের ভার ছুঁই ছুঁই। তবু কর্মে অদম্যা। কর্মকে তিনি যোগে পরিণত করেছেন। সকল কর্মই যে বিশ্ব স্রষ্টার প্রীতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়, তিনি তাঁর উদ্ভাবনায়ই প্রমাণ করে চলেছেন। এছাড়াও অভেদ দর্শনে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানে সমশ্রদ্ধা। অসা¤প্রদায়িক চেতনার মূল ধারক এ বিদূষী। যখনই ফোনে কুশল সংবাদ নেয়ার প্রয়োজন হয়, ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে “তোমরা কেমন আছো? সকলে আমার আশির্বাদ নিও।” পরিশেষে, “তোমরা ভালো থেকো।” এই যে এতো আন্তরিকতা, এর মধ্যেই তো জীবে প্রেমের বহিঃপ্রকাশ।
হিংসা, বিদ্বেষ, সা¤প্রদায়িকতার গন্ডি ভাঙ্গা এতো সহজ নয়। এগুলোই মানুষকে কুপমন্ডুক করে, সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করে। তিনি এগুলোর পার। সকল ধর্মের সার গ্রহণে, জীবনে প্রতিফলন ঘটানোয় পটু। “জীবন ক্ষণভঙ্গুর, মৃত্যু নিশ্চিত, তবে কেন তা মহৎ কাজে উৎসর্গ করিব না?” এ বাণী স্বামী বিবেকানন্দের। মানব কল্যাণে কাজ করার ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় প্রেরণা আছে কিনা জানা নেই। আর এ মহীয়সী নারীর সমস্ত জীবনটা সেবা ধর্মের মধ্যেই নিহিত। আপনার দিকে তাকানোর আর যেন ফুসরত নেই। শুধু পরার্থে কল্যাণের চিন্তা।
আর এক গুণবান ব্যক্তিত্ব, যাঁর সঙ্গে আমার আত্মিক এবং পারিবারিক সম্বন্ধ। তিনি হলেন জীবন চৌধুরী। একাধারে তিনি গীতিকার, নাট্যকার, সাংবাদিক, লোক গাঁথা সংগ্রাহক, ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার এক সময়ের সাব-এডিটর, মানব দরদী। এ দু’জনের একান্ত সান্নিধ্য আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। যার ফলে তাঁদের মহৎ জীবন নিয়ে লেখার সুযোগ পেয়েছি।
স্রষ্টা মানুষের মনকে বহির্মুখী করেই তৈরী করেছেন। এতো ভোগ্য বস্তু সম্মুখে। কেহ ইন্দ্রিয় পরবশ হয়ে দিগি¦ক ভ্রান্ত হয়ে তা ভোগ করছে, আর কেহ তার সাধ্যের বাহিরে বলে এগুলো দেখে, হাহাকার করছে। আত্মজ্ঞান বিস্মৃত সবাই। এর মধ্যেই কিছু অন্তর্মুখী মানুষের অবস্থান-যারা অপরের কল্যাণের জন্য ছট্ফট করে। ডঃ খান এমন এক সর্বোচ্চ মাতৃত্বের আদর্শে অনুরণিত, যা একটি উপমায় স্পষ্ট হবে। সতী, সাধ্বী, মহামানবী শ্রীমা সারদা দেবী-যিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সংঘ জননী, তাঁর সুশীতল ছায়ায় ডঃ খানের মানসিক অবস্থান। শুধু মানসিক নয় কায়িকভাবেও এ দেবীর পদমূলে তিনি। যে দেবী আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে বলেছিলেন, “শরৎ যেমন আমার ছেলে, তেমনি আমজাদও আমার ছেলে।” শরৎ মহারাজ সন্ন্যাসী, আর আমজাদ ছিল তখনকার সময়ে একজন ডাকাত। কিন্তু সারদা দেবীর সরল ভালোবাসায় উভয়ে সমভাবে সিক্ত। এ দেবীর আশির্বাদ এবং ভাবাদর্শ বয়ে পরিপুুষ্ট ডঃ মারুফী খান। তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এদেশের কত স্থানে পরিভ্রমন করেছেন তার শেষ নেই। ধর্ম সভার বক্তৃতায় শ্রোতাদেরকে মন্ত্রমুগ্ধ করেন আশার বাণী ও অমৃত কথার মাধুর্যে। চলায়, বলায়, বঙ্গ সংস্কৃতির পোশাক পরিধানে, তিনি যেন সাক্ষাৎ এ বঙ্গের মাতৃঘন মূরতি। আর কি এক অপূর্ব অনুভূতি এবং মাতৃ মমত্বের গভীরতায় গর্ভবর্তী মা ও অপুষ্টির স্বীকারে আক্রান্ত শিশুদের জন্য স্থাপিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণ গ্রামে তাঁর প্রচেষ্টায় একটি হস্পিটাল। একমাত্র মা-ই বুঝে সন্তানের বেদনা। তাঁর এ প্রচেষ্টাই প্রমাণ করে তিনি সকলের মা। অর্থাৎ যিনি এক বা দুটি সন্তানের নন সকলের। শীতার্ত মা ও শিশুরাও এ মায়ের আশির্বাদ বঞ্চিত নন। প্রতি শীত ঋতুতেও তাঁর শীত বস্ত্র উপহারে প্রীতি পূর্ণ হয় তারা। এ অসহায় মানুষগুলোর অশেষ আশির্বাদে এ মহীয়সী বেঁচে থাকবেন যুগ থেকে যুগান্তর। সব মানুষ মরে না। কিছু মানুষ অমর, অমৃতত্ব লাভ করে সবার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে। এরই নাম মানব জীবন। যা ক্ষয়হীন, অক্ষয়। তাঁদের শুধু দেহের বিনাশ এক কালে। রেখে যাওয়া কৃত কর্মের সুফল ভোগ করে সকলে। গুণী জ্ঞানের ভান্ডার উন্মুক্ত করেন সকলের জন্য। আর অন্যেরা তা লুফে নেয়। জ্ঞানী তাঁর মহিমা প্রচার করেন না, করে অন্যে। আমিও তাঁদের স্বচ্ছ সুন্দর গুণের প্রকাশক মাত্র। এতো বড় আধার লিখতে গিয়ে ত্র“টিও করি মনে হয়। তার জন্য ক্ষমার্হ।