(পূর্ব প্রকাশের পর)
(আঠারো)
১৯৮০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তারিখে সপ্রতিভের কলামে আমার এই লেখাটিতে তৎকালিন সময়ে বাংলাদেশের রাস্তাঘাট এবং সেসময়ের দুর্ঘটনাবলীর একটি চিত্র ফুটে ওঠে। পঠকবৃন্দের নিকট তা হুবহু তুলে ধরা হলো। বাংলাদেশের ৩ হাজার ৮শ ৫০ মাইল পাকা সড়ক পথ এ্বং ঐ সকল পথে চলাচলকারি যানবাহন আর দুর্ঘটনাবলীর বর্ণনাদি লিখতে গেলে পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পাওয়াই দুষ্কর। কারণ এই অধম যা লিখতে চায় তা অন্যান্য পতিবেদকরাই সে শূণ্যস্থান পূরণ করে ফেলেন। আজকাল সড়ক পথে চলতে গেলে যানবাহনের দুর্ঘটনা যেন মোয়া-মুড়কির মত ব্যাপার।
প্রতিদিন যাদের এসকল যানবাহনে চড়তে হয় কিংবা যানবাহনের ধারকাছ ঘেঁষে স্কুল-কলেজ, অফিস- আদালত, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কিংবা জরুরি প্রয়েজনে যাতায়াত করতে হয় তাদের জন্য শনি গ্রহ যেন অহরহ পিছু পিছু ছোটে। কেননা পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে ওমুক স্থানে বাস উল্টাইয়া বাস যাত্রী নিহত হইয়াছে। আহত হইয়াছে আরো জনাবিশেক। নিহত ব্যক্তিদের লাশ স্থানীয় হাসপাতাল মর্গে রাখা হইয়াছে। আহতদেরকে চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ -শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হইয়াছে। নিহতদের পরিচয় এখনো পাওয়া যায় নাই। এরপর জমি রেজিষ্টারির দলিলের গদের মত লেখা হয়; দুর্ঘটনাকবলিত ঘাতক বাসটি থানায় লইয়া যাওয়া হইয়াছে। এব্যাপারে থানায় একটি মামলা হইয়াছে। বাসের চালক ও কন্ডাক্টর পলাতক রহিয়াছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতো গেল পত্র-পত্রিকার কথা। তাছাড়া বাদবাকি দুর্ঘটনার কথাতো আর পত্রিকার পাতা পর্যন্ত পৌঁছেনা। এর সংখ্যাও কি কম? । দুর্ঘটনা সেতো নিছক দুর্ঘটনাই। এতে কারো কোন হাত নেই। বলতে গেলে আজকাল বাসে চড়ে কোথাও যাবার জন্য এরাদা করলে বাড়ি থেকে একদম বিদায়-আদায় নিয়েই বেরুতে হয়। সেই সঙ্গে মুদি দোকানীর দোকান বাকিসহ সাকুল্য দায়-দেনা পরিশোধ করেই বেরুতে হয়। কেননা মুদি দোকানি কিংবা পাওনাদারেরা তাদের বাকি খরিদ্দার কিংবা দেনাদেরকে বাসে চড়ে কোথাও যেতে দেখলে পাওনা টাকার জন্য দারুন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়। কারণ বেচারা যদি আর ফিরে না আসে? তাহলে যে তার পাওনা টাকা মাঠে মারা যাবে। অবশ্য কোন স্ত্রী তার মোহরানার পাওনা আদায়ের জন্য স্বামীর জামা টেনে ধরেছে কিনা এমন কথা কোনদিন শোনা যায়নি।
তবে আমার এক পরিচিত জনকে হঠাৎ কাফনের কাপড় কিনতে দেখে জিঞ্জেস করেছিলাম কে মারা গেছে ভাই? তিনি হেসে বল্লেন না ভাই কেউ মারা যায়নি। আমি ঢাকা যাবো কিনা তাই সঙ্গে করে কাফনের কাপড় নিয়ে যাবো। কাফনের কাপড়ের মধ্যে আমার ছবি ও ঠিকানা লেখা থাকবে। দুর্ঘটনায় মারা গেলে আমার লাশ যাতে লাশকাটা ঘর থেকে কাটা-ছাঁটা করার পর সেই এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলিম ভায়েরা আমাকে গোসল দিয়ে কাফনের কাপড় জড়িয়ে বাড়িতে পাঠাতে পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাছাড়া এতে বেওয়ারিশ লাশ হবারও সম্ভাবনা থাকবেনা কি বলেন? একথা শোনার পর আমি ভদ্রলোকের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলামনা।
সড়ক পথে প্রায়শ্চই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। আর এই সকল দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রান পাবার জন্য যাত্রী সাধারণকে সাবধানে পথ চলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। কারণ সমস্ত কলকাঠি সেতো চালকদের হাতেই। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশসহ সংশিলষ্টরা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানোর পরও এর কোন উন্নতি লক্ষ করা যায়না। সড়ক দুর্ঘটনা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আর এসকল দুর্ঘটনার জন্য চালকদেরকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। একেতো চালকেরা শিক্ষা-দীক্ষায় একেবারেই অপটু। তদুপোরি তাদের জ্ঞান-গরিমাও নগণ্য। কন্ডাক্টর আর হেলপাররা হঠাৎ করে গাড়ির ষ্টিয়ারিং ধরে রাতারাতি চালক বনে যায়। সড়ক মহাসড়কে চলাচলকারি এসকল ড্রাইভার গণের কোন প্রশিক্ষন নেই। এরা নাচতে নাচতে নাচুনি এর মত উক্ত যানবাহন চালাতে চালাতে তারা চালক হয়। এদের অধিকাংশই লেফট-রাইট বোঝেনা, ট্রাফিক সিগন্যাল চেনেনা। এসব যানবাহনে হেডলাইট থাকলেও তাদের আপার ডিপার সম্পর্কে ধারণা খুবই সীমিত। এছাড়া সকল যানবাহন চালকের অধিকাংশেরই যেমন কোন লাইসেন্স থাকেনা, -গাড়ির জন্য থাকেনা কোন বুø-বুক। রুট পারমিট সম্পর্কে তাদের নুন্যতম কোন ধারনা আছে বলে মনে হয়না। বাহনে প্যাসেন্জার তুলে নরম সিটে হেলান দিয়ে স্ফুর্তির সাথে দ্রæত গতিতে খ্যাপ মারতে থাকে, তারা এ কথা কস্মিনকালেও ভাবেনা যে,যে কোন সময় প্যাসেন্জারসহ নিজেও পেঁয়াজের খ্যাপে চলে যেতে পারে। আবার প্যাসেন্জার গণ ও জেনে বুঝেই এ ধরনের মরন ভেলার যাত্রি হয়ে থাকে। অনেকে আবার পয়সা বাঁচাতে গিয়ে ‘মফিজ’ হয়ে বাস কিংবা ট্রাকের যাত্রি হয়।ভেহিক্যাল এ্যাক্ট অনুসারে এ ধরনের যানবাহন রাস্তায় চলাচল সম্পুর্ন রূপে নিষিদ্ধ। এই নিষেধ উপেক্ষা করে সড়ক মহাসড়কে হরদম তারা চলাচল করে থাকে।
এ সব দেখার দায়িত্বে যাঁরা নিয়োজিত তারাও নাকি দশআনা-ছআনা করে থাকে। কিছু বকশিস বা নজরানার বিনিময়ে তারা দেখেও না দেখার ভান করে। হয়তো বা তাদের আস্কারা পেয়ে পেয়েই এ ধরনের যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান আরেকটি কারণ রয়েছে যা নাকি অনেকেই এ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান। আর তাহলো দেশের অপরিকল্পিত সড়ক পথ। সড়কপথের অতীত ইতিহাস হতে জানা যায় প্রায় ৬৩২ বছর আগে ফখর উদ্দিন মোবারক শাহ, সোনার গাঁয়ের স্বাধীন সুলতান থাকা কালীন একটি প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করেছিলেন। পরবর্তী আরো ২শ’ বছর পর শেরশাহ, আরেকটি প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করেন যার নাম গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড। এরপর এ দেশের রাস্তা ঘাটের তেমন কোন উন্নতি কোন রাজা-বাদশাহই আর করেননি। ইংরেজ আমলে বেনিয়া কোম্পানীর নীল বহনের জন্য কিছু কিছু রাস্তা নির্মিত হয়েছিলো যা কেবল নীল চাষিদের গরু-মহিষের গাড়ি আর নীল পরিদর্শন কারি সাহেবদের টমটম বা ঘোড়ার গাড়ি চলাচলের জন্য।
ইংরেজ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয় বটে তারা আবার ইংরেজদের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিলেননা। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের রাস্তা-ঘাটের উন্নতির দিকে তাদের নজর দেওয়ার ফুসরত ছিলোনা বললেই চলে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ২৪ বছরের গোঁজামিলের শাসন ব্যবস্থায় বাংলাদেশের রাস্ত-ঘাটের উন্নতি এক ছটাক পরিমানেও হয়েছিলো কিনা সন্দেহ। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা আচ্ছামত নাকানি-চুবানি খেয়ে চিরদিনের মত এদেশ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হলো। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করছে একথা নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি +হানাদার বাহিনী এদেশের রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট সব ধবংস করে দিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এদেশকে সুখি ও সমৃদ্ধশালী একটি দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রায়াস চালানোর কালে ‘৭৫ এর ১৫ আগষ্ট তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
এর মধ্য দিয়েই বলতে গেলে এদেশের সকল উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ে। আর এক্ষেত্রে এদেশের রাস্তাপথের উন্নতি সেতো সুদুর পরাহত। (ক্রমশ:)। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)