বগুড়ায় বিষাক্ত মদপান করে বিভিন্ন এলাকায় মৃত্যুর ঘটনায় হোমিও ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পৃথক পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ সদস্যরা।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন, পিএম (পারুল) হোমিও ল্যাবরেটরিজ এর সত্ত¡াধিকারী ফুলবাড়ি মধ্যপাড়ার মো: নুরন্নবী (৫৮), শহরের গালাপট্টি মুন হোমিও হলের আব্দুল খালেক (৫৫), করতোয়া হোমিও হলের শহিদুল আলম সবুর (৫৫) এবং হাসান হোমিও ফার্মেসীর কর্মচারী আবু জুয়েল (৩৫)। বুধবার সকালে বগুড়া সদর থানা প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা পুলিশের পক্ষে সাংবাদিকদের বিস্তারিত অবগত করেন জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বিপিএম (বার)। তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত এবং বগুড়া শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ এর ডাক্তারদের এর দেয়া তথ্যমতে বিষাক্ত মদপান করে এখন পর্যন্ত ৮ জনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়া গেছে। যারা হলেন, পুরান বগুড়া দক্ষিণপাড়া এলাকার রামপতির ছেলে আপন দুই ভাই প্রেম নাথ (৭০) এবং রামনাথ (৬০), প্রেমনাথের ছেলে সুমন রবিদাস (৩৮), কাটনারপাড়া এলাকার সাজু প্রাং (৪৯), ফুলবাড়ি দক্ষিণপাড়া এলাকার পলাশ মন্ডল (৩৫), একই এলাকার আব্দুল জলিল (৬৫), পুরান বগুড়া জিলাদারপাড়ার রমজান আলী এবং ফাপোড় পশ্চিমপাড়া এলাকার জুলফিকার আলী (৫৫)। পুলিশ সুপার জানান, রেকটিফাইড স্প্রিরিট এর সাথে মিথানল মিশানোর ফলে তা বিষ হয়ে যায়। দুটির রং একই হওয়ায় ক্রেতারা বিভ্রান্ত হয় এবং এই সুযোগ নেয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা। অল্প টাকায় অনেক নেশা করার লক্ষ্যে এই পন্থা অবলম্বন করে অনেক মানুষ যার নেতিবাচক প্রভাবে এতগুলো প্রাণ ঝড়ে গিয়েছে বগুড়ায়। প্রাথমিক ময়নাতদন্তে বিষক্রিয়ার এই বিষয়টি উঠে এসেছে।
এসপি আশরাফ জানান, গ্রেফতারকৃতরা আসামীরা দীর্ঘদিন থেকেই এই সাপ্লাই দিচ্ছে বিভিন্ন এলাকার ক্রেতাদের। হোমিও চিকিৎসার আড়ালে বগুড়ায় এই ব্যবসার অন্যমত এক মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মো. নুরন্নবী। তবে পুলিশের এই অভিযান ৪ জনেই থেমে থাকবে না, এর সাথে জড়িত সকলকেই আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে অভিযান কঠোরভাবে চলমান থাকবে বলে জানান তিনি। এদিকে গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় ৩০৪-ক/১০৯ পেনাল কোড ঋজুপূর্বক আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে এবং সেখানে তাদের প্রত্যেকের রিমান্ড আবেদন করা হলে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী প্রত্যেকের ২দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
এদিকে সংবাদ সন্মেলন পরবর্তী গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে নিয়েই গ্রেফতারকৃত আসামীদের হোমিও প্রতিষ্ঠানগুলোতে জেলার অতিরিক্ত পুর্লিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরী ও সদর সার্কেলের ফয়সাল মাহমুদের নেতৃত্বে দিনব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান চালায় বগুড়া সদর থানা এবং জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পৃথক পৃথক টিম। অভিযানের শুরুতে প্রথমে পারুল ল্যাবরেটরিজ এর কারখানায় পৌঁছালে সেখান থেকে এ্যালকোহল ও রেকটিফাইড স্প্রিরিট মিশ্রিত বিভিন্ন হোমিও ঔষধের জার জব্দ করা হয় যেগুলোর ব্যবহারের সঠিক তথ্য দিতে পারেননি আসামী নুরন্নবী। শুধু তাই নয় পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে হোমিও চিকিৎসার আড়ালে বিষাক্ত মদ বিক্রি করে এতগুলো তাজা জীবন কেড়ে নেওয়ার অপরাধে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে এলাকার শত শত মানুষ সমবেত হয়ে ¯েøাগান দিতে থাকে ঘটনাস্থলে। একইভাবে পরবর্তীতে করতোয়া হোমিও হলসহ বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অভিযান চালায় পুলিশ এবং উদ্ধার করে এ্যালকোহল ও রেকটিফাইড স্প্রিরিট জাতীয় বিভিন্ন তরল। উল্লেখ্য, গত রবিবার পুরান বগুড়ায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে মদপান করে মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় অল্প সময়ের মাঝেই বিষাক্ত মদপান করে ক্লিনিক ও শজিমেকে ভর্তি হয়ে মোট প্রায় ১৩ জন মারা গিয়েছে এমন সংবাদে পুরো জেলায় হৈ চৈ পরে যায় যদিও জেলা পুলিশের তথ্যমতে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে মোট ৮ জনের বাকিগুলোও হতে পারে তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত নিশ্চিত বলা যাচ্ছেনা।
বগুড়া হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা: এস.এম মিল্লাতের সাথে কথা বললে জানা যায়, বগুড়া জেলায় প্রায় ৪’শ জন হোমিও চিকিৎসক রয়েছেন যাদের মাঝে ড্রাগ লাইসেন্স আছে যার সংখ্যা ৫০ জনও হবেনা। অবৈধভাবে যারা বিভিন্ন নামে বেনামে হোমিও প্রতিষ্ঠান দিয়েছে তারাই অবাধে বিক্রি করছে এই রেকটিফাইট স্প্রিরিট বা তরল এ্যালকোহল।
এদিকে বগুড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুরো জেলায় বগুড়া সার্কেলের আওতায় শুধুমাত্র ৭ জন হোমিও চিকিৎসক, ২টি সরকারি প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে শজিমেক এবং এশেনশিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেড এবং একটি হোমিওপ্যাথিক ল্যবরেটরির রেকটিফাইড স্প্রিরিট ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে। বাকি যারা আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ব্যবহার করছে তারা সকলেই অবৈধ।
হোমিও ঔধধের নামে দীর্ঘদিন ধরে যারা এই এ্যালকোহল কিংবা রেকটিফাইড স্প্রিরিট মিশিয়ে নেশাজাতীয় দ্রব্য বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে এখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেই মর্মে আকুল হয়ে অপেক্ষায় আছে বগুড়াবাসী। যদিও ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলে মাঠে নেমেছে কঠোরভাবে।