মহসিন আব্দুল্লাহ’র রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাÐ নিয়ে লেখা ‘উইঘুরের কান্না’ বইটি বেশ কয়েকদিন থেকে পড়ছিলাম। পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিসত্ত¡াকে সমূলে নির্মূল করার যাবতীয় প্রচেষ্টা চীন সরকার দীর্ঘদিন থেকেই করে যাচ্ছে। মিডিয়ার প্রতি কড়া বিধি নিষেধ থাকার কারণে চীনের অভ্যন্তরীন গোপন কর্মকাÐের অনেক তথ্যই হয়তবা বহিঃবিশ্বের কান অবধি পৌছায় না। তারপরও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্য কিছু তথ্য-উপাত্ত সময়ের মারপ্যাঁচে নানা ফাঁক-ফোকর গলিয়ে বেরিয়ে আসে। ঠিক তখুনি আমরা চিনের আসল চেহারাটা বুঝতে পারি। শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেলেই একটি দেশ কখনো উন্নত হয়না। সেই সাথে যদি মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায্যতা, নীতি-নৈতিকতা,আধুনিক গণতন্ত্র ও গণমানুষের অধিকার আদায় প্রতিষ্ঠিত না হয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের মর্যাদা ও অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত করা। যদি রাষ্ট্র সেটি করতে না পারে, শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে মরিয়া হয়ে ওঠে আমরা কখনোই সেই রাষ্ট্রকে উন্নত রাষ্ট্র বলতে পারি না। বড় জোর সেই রাষ্ট্রকে একটি ধনী রাষ্ট্র বলা যায়। কেননা ধনী রাষ্ট্র ও উন্নত রাষ্ট্রের মধ্যে অবশ্যই একটা সংজ্ঞাগত বা কাঠামোগত পার্থক্য রয়েছে। চীন ক্রমান্বয়ে ধনী রাষ্ট্রের দিকে এগুচ্ছে কিন্ত তারা উন্নত হচ্ছে না।
আমরা সকলেই জানি গোটা বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক খরা, করোনা মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন। এর মধ্যেও চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাঁ সাঁ গতিতে বেড়েই চলেছে। কোভিড-১৯ মহামারী সংকটকে সামাল দিয়ে চীন এখন এটিকে তার অনুক‚লে নিয়েছে । যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকনোমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) এর তথ্যমতে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশ হিসেবে চীন আত্মপ্রকাশ করবে। এই প্রসঙ্গে সিইবিআরের ডেপুটি চেয়ারম্যান ডগলাস ম্যাকউইলিয়ামস একটি গুরুত্বপূণ মন্তব্য করেছিলেন, “আমরা ধারণা করছি ২০২৫ সালে চীন তাদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যেই একটি উচ্চ আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হবে এবং আমরা একবছর আগেও যা মনে করেছিলাম তার পাঁচ বছর আগেই-তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে” অথার্ৎ চীনের অর্থনৈতিক পরিকল্পানার কাঠামোটি যে কতটা শক্তিশালী এসবইনডিকেটর দেখলেই সেটি সহজেই অনুমাণ করা যায়।
চীন অর্থনৈতিক দিক থেকে আরো বেশি সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠুক, তাতে আমাদের কোন আপত্তি নাই। কিন্তু একটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীন সত্ত¡ায় আঘাত হানার অধিকার কারো নেই। এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের মুসলিঘ সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায়ের প্রতি চীন সরকারের যে অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতনের অসংখ্য প্রমাণ ও দলিল বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে বের হয়ে এসেছে। এই সম্প্রদায়ের প্রতি দমনপীড়নের ঘটনায় চীন সরকার বহিঃবিশ্বে বহুবার নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছে কিন্তু তবুও তারা দমনপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ করেনি। বরং বিভিন্ন কায়দায় এর মাত্রাটা আরো বেড়েছে। এই বিষয়ে চীনের প্রতিবেশী ও প্রতিদ্বন্ধ¦ী দেশ জাপানও মুখ খুলেছে। জাপানের মন্ত্রপরিষদের প্রধান সচিব ক্যাটসুনোবু কাটো সাফ জানিয়ে দিয়ে বলেছেন, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের প্রায় ১০ লাখ মুসলিম উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষকে চীন সরকার অন্যায়ভাবে আটক করে তাদের ওপর নির্মম শারীরিক ও মানুষ নির্যাতন চালাচ্ছে। এটি খুব দ্রæতই বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে তিনি আরো বলেন, জাপান বিশ্বাস করে যে স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আইনের শাসন যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সর্বজনীন, তা চীনেও যেন নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! চীন এখন নিজেকে বিশ্বের মোড়ল ভাবতে শুরু করেছে। অর্থাৎ তারা এখন যাহা করিবে, তাহাই সহীহ!
উইঘুর শব্দটি এসেছে মূলত তুর্কি শব্দ থেকে। যার অর্থ একতাবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধ। এরা মূলত তুর্কি বংশোদ্ভ‚ত জাতিগোষ্ঠী। চীনে প্রায় ৫৬ টি নৃতাত্তি¡কজাতিগোষ্ঠী রয়েছে এর মধ্যে উইঘুর অন্যতম। চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল অংশ জুড়ে জিনজিয়াং প্রদেশে এদের বসবাস। এর সীমানা প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার বর্গমাইল। চীনের যতগুলো প্রদেশ রয়েছে জিন জিয়াং হচ্ছে সবগুলোর থেকেই বড়। তিব্বতের মতোই জিন জিয়াং প্রদেশও চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকা। কিন্তু এটি কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। যারফলে এই উইঘুর সম্প্রদায় স্বাধীন দেশেও পরাধীন।
উইঘুর শব্দটি এখন প্রায় বেশিরভাগ দেশেই পরিচিত। উইঘুর বললেই সেটি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে বোঝায়। চীন ছাড়াও আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ বিভিন্ন দেশেই এই উইঘুর সম্প্রদায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে চীন সরকারের নির্মম অত্যাচারে অনেকেই দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমান এই উত্তরাধুনিক যুগেও জাতিগত পরিচয়ে নিপীড়নের শিকার এর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়টি। চীনা সরকারের নৃশংস আগ্রাসনে কথায় কথায় নিষিদ্ধ আর সন্দেহ হলেই গ্রেফতার। এই হল উইঘুর সম্প্রদায়ের জীবনকাহিনী। দুনিয়ার অদ্ভ‚দ সব বিধিনিষেধ এখানে জারি করে রাখা হয়েছে। গোফ ছাড়া কেউ দাঁড়ি রাখতে পারবে না। ১৮ বছরের নীচে কেউ মসজিদে নামাজের জন্য প্রবেশ করতে পারবে না। নারীদের ক্ষেত্রে হিজাবের ওপরেও রয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। যদিও হিজাব উইঘুর নারীদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ। তথাপি চীন সরকার এর সঙ্গে ধর্মীয় একটি তকমা লাগিয়ে দিয়ে নানা ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে। এছাড়াও রাস্তায় দলবেধে হাটা, কিংবা টুপি পরার ক্ষেত্রেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। পরিবারের সন্তান জন্মের পর তাদের পছন্দমতো নাম রাখারও স্বাধীনতা নেই। কারণ জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর সম্প্রদায়ের জন্য ২৯ টি ইসলামি নাম নিষিদ্ধ। উইঘুরদের সকল ধর্মীয় কাজ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়। রোজা রাখা কিংবা নামাজ পড়াকে এখানে বিশালবড় সন্ত্রাসী কাজ হিসেবে মনে করা হয়। ফলে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে কেউ যদি রোজা রাখেন বা নামাজ পড়েন তবে চীন সরকার চাইলেই তাকে গ্রেফতার করতে পারেন।
উইঘুর নেতা সালিহ হাজিমকে হয়তবা অনেকেই চিনবেন। চীনা ভাষায় পবিত্র কুরআন শরীফ অনুবাদের দায়ে তাকে একসময় গ্রেফতার হতে হয়েছিল এবং পুলিশে নির্যাতনে তিনি জেলখানায় মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়াও আল জাজিরা টিভি চ্যানেলে একটি সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল যে, চীনের উইঘুর সম্প্রদায়ের একজন মুসলিম লম্বা দাঁড়ি রাখায় তাকে চীনা আদালত ৬ মাসের কারাদÐ দিয়েছিল এবং তার স্ত্রীকে ২ বছরের কারাদÐ দেয়া হয়েছিল। তার স্ত্রীর অপরাধ ছিল, তার স্বামীর লম্বা দাঁড়ি রাখার বিষয়টি তিনি জেনেও কেন যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাইনি।
এরকম হাজারো অদ্ভ‚দ সব বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপরে। এর প্রতিবাদ করতে যারাই এসেছে, তারাই ঘুম, খুন কিংবা নানারকম পৈশাচিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে। এছাড়াও চীনা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছে যে তারা প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়কে ছোট ছোট বন্দী শিবিরে আটকে নানা ধরণের নির্যাতন চালাচ্ছে। সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা ধরণের বিধি নিষেধ। এছাড়াও উইঘুর সম্প্রদায়কে নিয়ে জাতিসংঘের একটি তদন্তে আরো ভয়ংকর কিছু তথ্য ওঠে এসেছে, চীন সরকার এসব মুসলিম সম্প্রদায়কে আধুনিক শিক্ষা দেয়ার নাম করে, তাদের ধর্মীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করছে। তাদেরকে নতুন ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাখা দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলমানদের প্রতি চীনের এসব বর্বরোচিত আচরণের বিরুদ্ধে গত বছর ৬ অক্টোবর ২০২০ জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত একটি বৈঠক থেকে বিশ্বের ৩৯ টি দেশ চীনের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানান এবং সংখ্যালঘুদের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য চীনকে আহŸান জানান। এর আগে ২০২০ সালে ফেব্রæয়ারি মাসে জিন জিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের নিপীড়নের ১৩৭ পৃষ্টার একটি নথি ফাস হয়ে যায়। চীনের ক্ষমতাসীন দলের কিছু বিশ্বস্ত কর্মি উইঘুর মুসলিমদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের তথ্য সংগ্রহ করে কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করে এরপর চিহ্নিতদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়। ক্ষমতাসীনদের এসব বিশ্বস্ত কর্মিরা প্রত্যেকেই কয়েকটা করে বাড়ির দায়িত্ব নেয়, তারপর তাদের সখ্যতা বা বন্ধুত্ব গড়ে তুলে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে সরকারকে সরবরাহ করে থাকে। অর্থাৎ উইঘুরের প্রতিটি পরিবারের পিছনেই কোন কোনভাবে গোয়েন্দা নিযুক্ত করা থাকে। কেউ প্রতিবাদ করলেই, গ্রেফতার, গুম অথবা খুনের শিকার হতে হয়।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে গোটা বিশ্ব এখন অশান্ত, অসুস্থ। এই ক্ষত কাটিয়ে ওঠতে হয়তবা দীর্ঘ সময় লাগবে। আধুনিক বিজ্ঞান প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে পৃথিবীটা আবার সুস্থ হয়ে ওঠে। মানুষ প্রাণখুলে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। অপরদিকে একদল অসাধু চিন্তার প্রতিকৃতি মানুষের এই দুঃসময়ে ব্যবসায়িক ফায়দা লুটের ধান্দায় ব্যস্ত। তাদের এসব বিকৃতি চিন্তার কারণে মানবতা আজ লজ্জিত। তবুও আশা জাগে কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক হিসেবে আমরা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করছি। কিন্তু উইঘুরদের মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আমরা কী করতে পারছি? এই কান্না থামবে কবে? (সংগঠক ও প্রাবন্ধিক)