সাংবাদিকতার সাড়ে তিন যুগ – চৌদ্দ


মাটি কাটার শ্রমিক হাচেন আলী সত্যি সত্যিই বীর বনে গেল। হাচেন বীর কুস্তি লড়ার জন্য যে কোন লোককে আহবান জানায়। কিন্তু কেউই তার সাথে কুস্তি লড়তে রাজি হয়না। তার এই বীরত্বের কথা শুনে পাবনা সদর থানার দাপুনিয়া ইউনিয়নের কতিপয় উৎসাহি ব্যক্তি তাকে জব্দ করার জন্য মহিষের সঙ্গে কুস্তি লড়ার জন্য প্রস্তাব দিয়ে বসে। কিন্তু হাচেন বীর তাতে দমবার পাত্র নয়। তাই সে দ্বিধাহীন চিত্তে তাতে রাজি হয়ে যায়। হাচেন বীর স্বদম্ভে ঘোষণা করে এটা তো মামুলি ব্যাপার। মহিষের সঙ্গে লড়াই করা তো দুরে থাক সে হাতির সঙ্গেও কুস্তি লড়তে রাজি আছে বলে জানান দেয়। এতে লোকজন অধিক কৌতুহলি হয়।
দিন ক্ষণ ঠিক করা হলো। দাপুনিয়া, টেবুনিয়া, আওতাপাড়াসহ বিভিন্ন হাটে ঢোল শহরত দিয়ে জনসাধারণকে জানান দেওয়া হলো এই বলে যে, হৈ হৈ কান্ড রৈ রৈ ব্যাপার। মানুষের সঙ্গে মহিষের লড়াই। অমুক তারিখে মির্জাপুর ঈদগাহ ময়দানে নাজিরপুরের হাচেন বীর মহিষের সঙ্গে কুস্তি লড়বে। মহিষের সঙ্গে মানুষের লড়াই দেখার জন্য তাই সকলকে আহবান জানানো যাচ্ছে। খালি টিন দ্বারা ঢেডরা পিটিেিয় তা প্রচার করা হলো। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো। নির্ধারিত দিনক্ষণ মোতাবেক হাজার হাজার দর্শকের ভিড় জমে উঠলো সেই ঈদগাহ ময়দানে। বেশ কিছু দোকানি এই সুযোগে পান-বিড়ির দোকান দিয়ে বসলো। মুড়ি মুড়কি খাজা- মোয়া, মদনকটকটি, ঝাড় বিস্কুট বিক্রেতাও বাদ গেলনা। দেখতে দেখতে সেখানে যেন মেলা জমে উঠলো। বানের স্রোতের মত লোকজন সেখানে জমায়েত হতে থাকে। সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
আজকালকার দিনের মত হাটে-বাজারে ওষুধ বিক্রি, বিড়ির কাটতি কিংবা মালাই বরফ বিক্রি করতে যেভাবে হাটে-ঘাটে মাইক ব্যবহার করে থাকে তখনকার দিনে মাইকের কোন প্রচলন ছিলোনা বলে ‘ও দরিয়ার পানি তোর মতলব জানি…, রুপে আমার আগুন জ্বলে যৌবন ভরা অঙ্গে…., কিংবা ওরে ও পিতলের কলসি তোরে লইয়া যাব যমুনায়…. এধরণের গান বাজানো হয়নি তবে হৈ হুললোড় আর হাসি তামাসা হয়েছে অনেক। বছরের দুটি ঈদ ছাড়া যেসকল কৃষক ও দিনমজুর তাদের পেটের ভাত জোগান দিতে কোনমতেই কাজ বাদ দিতে পারেনা তারা সকলেই কাজ ফেলে মহিষের সঙ্গে হাচেন বীরের লড়াই দেখতে একরাশ কৌতুহল নিয়ে জমায়েত হয়েছে। উপস্থিত সকলের একই কথা আমরা লড়াই দেখতে চাই।
কিন্তু লড়াই কোথায়। কুস্তি লড়াইয়ের জন্য যার নাম ঘোষণা করা হয়েছে সেই হাচেন বীর কোথায় আর মহিষই বা কোথায়?
মধ্যম বয়সের এক ব্যক্তি ঈদগাহের সান বাঁধানো (ইমাম সাহেবের খুতবা পড়ার স্থানে) অর্থাৎ মিন্বরের উপর দাঁড়িয়ে টিনের হর্ণে মুখ লাগিয়ে বলতে লাগলো: ভাই সব, আপনেরা অধৈর্য হবেননা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আজকের বিশেষ আকর্ষণ হাচেন বীর ও হাচেন বীরের সঙ্গে লড়াই করার জন্য মহিষ এসে হাজির হবে। আপনারা কেউ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করিবেননা। মেহেরনানি করিয়া একটু অপেক্ষা করুন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সকলেই তখন চিৎকার চোমেচি শুরু করে দেয়। আমরা ওতো শত বুঝিনা আমরা লড়াই দেখতে চাই। এর কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যিই হাচেন বীর জনতার ভিড় ঠেলে ঈদগাহ ময়দানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দু হাতের কব্জিতে এবং গলায় লাল রংয়ের রুমাল পেঁচানো, পরনে লাল রংয়ের হাফ প্যান্ট পরে হাচেন বীর বীরদর্পে মাঠের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। বড় মাপের রাজনৈতিক নেতার জন্য শত ভীড়ের মাঝেও জনসাধারণ যেমন করে নেতার গমনাগমণের পথ করে দেয় ঠিক তেমনি লোকজন হাচেন বীরের জন্য পথ করে দিলো। (ক্রমশ:) (লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব