সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে প্রত্যয়

বাংলাদেশ ও ভারত পারস্পরিক সহযোগিতা, সম্পর্ক ও বোঝাপড়া আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক ভার্চুয়াল বৈঠকে এই অঙ্গীকার করেন।

বৈঠকে সীমান্ত হত্যা বন্ধ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, করোনা মহামারি মোকাবিলায় টিকা সহযোগিতা, রপ্তানিসহ বাণিজ্য বৃদ্ধি, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্বালানি সহযোগিতাসহ সব ইস্যুতে দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেন। পরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারকে সই হয়।

অনুষ্ঠানে দীর্ঘ ৫৫ বছর পর আবারও নীলফামারীর চিলাহাটি সীমান্ত থেকে পশ্চিমবঙ্গের হলদিবাড়ী পর্যন্ত রেল যোগাযোগের উদ্বোধন করা হয়। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ভারতের ডাক বিভাগ প্রকাশিত একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন এবং ‘বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল এক্সিবিশন’-এর উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে গণভবন থেকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নয়াদিল্লি থেকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব প্রদান করেন।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতিকে আরো সংহত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, উভয় দেশ বিদ্যমান সহযোগিতামূলক ঐকমত্যের সুযোগ নিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে আরো সংহত করে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভ্যালু-চেইন আরো সমৃদ্ধ করতে পারে।’ প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে প্রচলিত যোগাযোগব্যবস্থাকে এ বিষয়ে অনুঘটক হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেল যোগাযোগ পুনরায় চালু এর উদাহরণ।

বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নির্ভরতাকে আমরা আনন্দের সঙ্গে স্বীকৃতি দিই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেশ কিছুসংখ্যক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের উত্পাদন ও সেবা খাতে নিযুক্ত রয়েছেন এবং তারা নিজ দেশ ভারতে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক পর্যটক এবং চিকিত্সাসেবা গ্রহণকারীকে ভারত গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত অতিক্রম করছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠারও ৫০তম বছরে পা রেখেছে। তিনি এ সম্পর্কে আরো বলেন, ‘আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করছি। মাত্র কয়েক মাস আগে, আপনাদের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী আমরা উদ্যাপন শেষ করেছি।’

এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলো যৌথভাবে উদ্যাপনের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত হওয়ায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও জনগণের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মানুষ আনন্দ, মুক্তি এবং উদ্যাপনের চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তিনি এই মাহেন্দ্রক্ষণে গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদ এবং ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর শহিদ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য ভারত সরকার ও জনগণকে জানাই কৃতজ্ঞতা।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ পরিস্থিতির উদ্ভবে বিশ্বব্যাপী লাখো মানুষের মৃত্যু, জীবন-জীবিকা বাধাগ্রস্ত হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, সম্ভবত কোভিড-১৯ মহামারির সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। তিনি বলেন, এই বছরের গোড়ার দিকে ঢাকায় আপনাকে স্বাগত জানানোর ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেছে। তবুও আমাদের গত শীর্ষ সম্মেলনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী, এই ক্রান্তিকালে উভয় পক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেভাবে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এগিয়ে নিয়েছে তা প্রশংসাযোগ্য। শেখ হাসিনা ভারতের মতো জনবহুল দেশে কার্যকরভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করে বলেন, বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত ও জনবহুল অঞ্চলে কোভিড-১৯ যেভাবে আপনার সরকার মোকাবিলা করছে তার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এ সময় শেখ হাসিনা আগামী বছর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানান।

‘ভারত সব সময়ই বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেয়’

‘প্রতিবেশীর অগ্রাধিকার’ নীতিতে ভারত বিশ্বাসী উল্লেখ করে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত সব সময়ই বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার প্রদান করে এসেছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার এই নীতি দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই আমার অগ্রাধিকারে রয়েছে।’

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এই বছরটিকে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং আখ্যায়িত করে মোদি বলেন, ‘সন্তুষ্টির বিষয় এই কঠিন সময়েও ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে চমত্কার সহযোগিতা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘মেডিসিন বা চিকিত্সা সরঞ্জাম বা স্বাস্থ্য পেশাদারদের একসঙ্গে কাজ করা ছাড়াও ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও আমাদের মধ্যে ভালো সহযোগিতা রয়েছে।’ তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, ‘আপনাদের সব প্রয়োজনীয়তার প্রতি আমি বিশেষ মনোযোগ দিতে চাই।’

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য ছাড়াও এ বছর অন্যান্য ক্ষেত্রেও দুই দেশের মধ্যে অংশীদারিত্ব অবিচ্ছিন্নভাবে এগিয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা স্থল সীমান্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাধা হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছেন এবং উভয় দেশের মধ্যে যোগাযোগের উন্নতি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন উপায় যুক্ত করা হয়েছে এবং এগুলো আমাদের সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করার আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতি আপনার (শেখ হাসিনা) ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতিও খুব স্পষ্ট।’ ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষ্যে তিনি সব ভারতীয় জনগণের পক্ষ থেকে তার শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘মুজিব চিরন্তন, বঙ্গবন্ধুর বাণী চিরায়ত এবং এই অনুভূতি দিয়েই আমরা তার উত্তরাধিকারকে সম্মান করি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আপনার (শেখ হাসিনা) মহান নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।’

‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষ্যে ভারতীয় ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্তকরণ এবং ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী এবং বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে একটি ‘ডিজিটাল এক্সিবিশন’ দুই প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। নরেন্দ্র মোদি বলেন, আমি আশা করি বাপু এবং বঙ্গবন্ধুর এই প্রদর্শনীটি আমাদের যুবসমাজকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। যেখানে কস্তুরবা গান্ধী এবং বঙ্গমাতার (বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) জন্য আলাদা একটা বিভাগ রয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি একাত্তরে বাংলাদেশকে মিত্রবাহিনী হিসেবে সহযোগিতা করতে গিয়ে আত্মাহুতিদানকারী ভারতীয় বীরদের জন্য বুধবার ১৬ ডিসেম্বর (বাংলাদেশের বিজয় দিবস) নয়াদিল্লির জাতীয় যুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ‘চিরন্তন শিখা’ থেকে ‘স্বর্ণিম বিজয় মশাল’ প্রজ্বলিত করেন। সেই প্রসঙ্গ টেনে মোদি তার ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৯তম বর্ষপূতিতে তিনি জাতীয় যুদ্ধ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এবং বিজয়ের সোনার মশাল জ্বালিয়েছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, তারা ১৬ ডিসেম্বর থেকে বছরব্যাপী সুবর্ণ বিজয় উদ্যাপন করছেন, যে সময়ে পুরো ভারত জুড়ে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এ সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ আত্মত্যাগকারী সবার প্রতি তিনি শ্রদ্ধা জানান। তিনি ২০২১ সালের ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে বলেন, ‘আগামী বছর বাংলাদেশ সফরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পাওয়া আমার জন্য সম্মানজনক।’

ব্রিকস-এ যোগ দেবে বাংলাদেশ

ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী ভার্চুয়াল সামিটের পর গতকাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এতে দুই দেশের সম্পর্কের ঐতিহাসিক পটভূমি, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক সহযোগিতা, পানি, সীমান্ত, জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তিসহ সবই স্থান পায়। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্যোগে গঠিত ব্রিকস-এ বাংলাদেশ যোগ দেবে। তিনি জানান, ভারত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে ৩ কোটি ডোজ করোনা টিকা দেবে। টিকার সরবরাহ, সংরক্ষণ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা দেবে। রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনে ভারত কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। তিস্তার পানি বণ্টনে বাংলাদেশের তাগিদে ভারত আন্তরিক ও অঙ্গীকার পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অভ্যন্তরীণ মতৈক্যের পর তা সম্পন্ন হবে। অন্যান্য অভিন্ন নদীর ব্যাপারে পানি সংক্রান্ত ফোরামগুলো কার্যকর হবে। সীমান্তে হত্যা শূন্যে আনতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত করা হবে।