এবাদত আলী
১৯৭৯সালের শেষের দিকে ভরা শীত মৌসুমে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের উন্নতি কল্পে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য বিভিন্ন জনের নিকট হতে দাবি উঠতে থাকে। এসময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক প্রষ্ঠিানগুলোতে যাত্রা ও সার্কাস প্রদর্শনের বিষয় যেন রেওয়াজে পরিণত হয়। কিন্তু প্রেসক্লাবের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যাত্রানুষ্ঠানের মত বিষয় নিয়ে ব্যাক্তিগতভাবে আমার মন সায় দেয়না। কিন্তু কথায় বলে দশের চক্রে ভগবান ভূত। ঠিক তেমনি দশা হলো আমাদের। আমরা যারা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজনের বিপক্ষে অবস্থান করছিলাম তাদের যেন একঘরে হবার জোগাড়। কারণ যুক্তি হলো সাংবাদিকদের কি তবে সাধ আহলাদ বলে কিছু নেই। আর এই যাত্রানুষ্ঠানতো সখের জন্য নয়, নবগঠিত প্রেসক্লাবের উন্নয়ের জন্য। এতে আপত্তির কিইবা থাকতে পারে। এমনি অবস্থার মাঝে একদিন প্রেসক্লাবের মিটিংি ডাকা হলো।
উক্ত মিটিংএ উপদেষ্টা পরিষদকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। মিটিংএ যাত্রানুষ্ঠানের বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। কথায় বলে “একেতো নাচুনে বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি।” যাত্রা পালার কথা শুনে সবাই একবাক্যে সমর্থন দিলেন যে প্রেসক্লাবের উন্নয়ন কল্পে অবশ্যই যাত্রানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা দরকার। যাত্রা পরিচালনার জন্য প্রশাসনের অনুমতি, যাত্রা পরিচালনার জায়গার ব্যবস্থা, যাত্রা পার্টি ঠিক করা, এক কথায় যাত্রা পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হলো। পদাধিকার বলে প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে আমাকে (এবাদত আলী) উক্ত কমিটির সভাপতি হতে হলো। প্রেসক্লাবের আব্দুস সাত্তার মিয়া হলেন সম্পাদক, যাত্রা পরিচালনা কমিটির, সহ সভাপতি হলেন বিশিষ্ট সমাজসেবক বেরুয়ান গ্রামের ছাদেক আলী বিশ্বাস, সদস্যরা হলেন বরুরিয়া গ্রামের আব্দুল আজিজ খাঁন, শ্রীকান্তপুরের আজাদ হোসেন জুনি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জুব্বার প্রমুখ । এছাড়া প্রেসক্লাবের অন্যান্য কর্মকর্তা ও সদস্যগণ পাদাধিকার বলে যাত্রা কমিটির সদস্য হিসেবে রইলেন।
কমিটির সবাই বেশ আশাবাদি যে, যাত্রা পরিচালনা করে প্রেসক্লাবের যথেষ্ট উন্নয়ন হবে। কমিটি গঠনের পর প্রথমে ছাদেক আলী বিশ্বাস খবর দিলেন সুজানগর থানার দুলাই বাজারে যাত্রানুষ্ঠান চলছে। সেখানে গিয়ে যাত্রাদলকে বায়না দিয়ে আসতে হবে। অনিচ্ছা সত্তেও আমাকে দুলাই যেতে হলো। ছাদেক আলী বিশ্বাসের সঙ্গে আমি (এবাদত আলী, সভাপতি, আটঘরিয়া প্রেসক্লাব), সাংবাদিক এইচকেএম আবু বকর সিদ্দিক, কার্যকরি সদস্যসহ বেশ কজন মিনিবাসে চেপে দুলাই বাজারে গিয়ে পৌছলাম। রাত বোধ করি তখন সাড়ে নটা হবে। আমরা বাজারে পৌঁছতেই যে বিষয়টি প্রথমে নজরে এলো তা হলো যত্রতত্র জুয়ার আসর। এক একটি জুয়ার ফড়ে মাছির চাকের মত লোকজন ভিড় করে রয়েছে। আমি তখন মনে মনে ভাবছি যদি প্রেসক্লাবের নামে যাত্রা চালাতে গিয়ে জুয়ার আসর বসাতে হয় তাহলে মান ইজ্জত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা। আমি এবং আরো দুএকজন সাংবাদিক তৎক্ষনাৎ ছাদেক বিশ্বাসকে বল্লাম ভাই চলেন আমরা ফিরে যাই। যাত্রা চালাতে গিয়ে যদি জুয়ার আসর বসাতে হয় তাহলে প্রেসক্লাবের অমন উন্নয়ন কিন্তু আমরা কামনা করিনা। ছাদেক বিশ্বাস বললেন, আপনারা খালি খুঁত খুঁজে খুঁজে বেড়ান ভাই। ইরা যদি গু খায় তাহলি কি আমরাও গু খাবো । তার এমন স্বদিচ্ছার কথা শুনে বেশ ভালোই লাগলো।
ছাদেক বিশ্বাস আমাদেরকে নিয়ে গেলেন অপেরার লাইন ম্যনেজারের নিকট। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জন্য চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করলেন। বাবুর্চিকে ডেকে আমাদের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থার কথাও বলে দিলেন। যাত্রাদলের ভাষায় আমরা তখন নায়ক পার্টি। সারা রাত থেকে যাত্রানুষ্ঠান দেখতে হবে। দেখে পছন্দ হলে বায়না-বাট্টা করতে হবে। এই নায়ক পার্টির যথেষ্ট সন্মান। তারা অবাধে সাজঘরে যেতে পারবেন, নায়ক এবং নায়িকাদের সাথে কথা-বার্তা বলতে পারবেন। নাচের শিলপীদের সাথে নাচের বিষয়সহ অন্যান্য শিলপীদের সঙ্গেও তারা যেকোন আলাপ করতে পারবেন। তাতে কোন নিষেধ নেই। তবে দলের একজন লোক তাদের সাথে থাকবে।
যাক সেকথা। যাত্রার কারণে সারা এলাকা জুড়ে সরগরম হাওয়া। দোকানিদের বেচা বিক্রি দারুন। লোকে লোকারণ্য । এখানে সেখানে কাবলা কাবলা লোক। যে যার মত খোশ গল্প করছে। সকলেরই শুধু অপেক্ষা কখন যাত্রানুষ্ঠান শুরু হবে। বিশাল এলাকা জুড়ে ঢেউ টিনের বেড়া দেওয়া হয়েছে । যাত্রা প্যান্ডেলের ভিতরে হ্যাজাকের আলোতে আলোময়। দুএকটা ডে-লাইট (কেরোসিনের তেল ও ম্যান্টালের সাহায্যে জ্বলে, দেখতে গোলাকার, যা উব্দা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ) ও ঝুলানো হয়েছে যার আলো আরো বেশি জায়গা আলোকিত করে রেখেছে। টিকিট ক্রয়ের জন্য মাইকে বার বার দর্শকদেরকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। আসুন ভাই আর কিছুক্ষণ পর ই দেখতে পাবেন এক ঝাঁক ডানা কাটা পরীর রিনিক ঝিনিক নাচ। এমনি আরো শতেক শব্দের গাঁথুনি দিয়ে প্যান্ডেলে প্রবেশের জন্য দর্শকদেরকে স্বাদর আমন্ত্রণ জানানো হচেছ। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আবহ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যাত্রা পালা আরম্ভ হতে এখনো অনেক দেরি। আমরা কজন মিলে এদিক সেদিক ঘোরা-ঘুরি করছি। এমন সময় হঠাৎ করে চারদিকে হুড়াহুড়ি ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল। যে যেখান দিয়ে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে। আর তাদেরকে পিছন থেকে পুলিশ তাড়া করছে। আমরা ক্ষণিকের জন্য হলেও হতচকিত হয়ে ঠাঁয় দাড়িয়ে রইলাম। (ক্রমশঃ)। (লেখক: সাংবাদিক কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
বাসা: টেবুনিয়া, পাবনা।
মোবাইল: ০১৭১২২৩২৪৬১