১৯৭১ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারেই গুলি করে হত্যা করা হয় শহীদ তারা মিয়াকে

মশাহিদ আহমদ, মৌলভীবাজার ঃ মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদান কারি শহীদ মোঃ তারা মিয়া। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে ফেব্র“য়ারিতে শ্রীহট্ট মহকুমার (বর্তমান জেলার রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের অন্তর্গত) চাঁদভাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম ধনাই মিয়া এবং মাতা মরহুম জমিলা খাতুন। অষ্টম ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। তিন বিধবা মাতার (একজন সন্তানহীন চাচী সহ) একমাত্র ছেলে এবং সাত বোনের একমাত্র ভাই। সদা হাস্যজ্বল, সহজ সরল মনের অধিকারী, পরোপকারী, স্বাধীণচেতী এবং ছোটবেলা হতে গ্রামেই বেড়ে উঠা। তিনি চাদঁভাগ চন্ডী প্রসাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক শিক্ষা, বিমলা চরণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় হতে মাধ্যমিক এবং মৌলভীবাজার সরকারী কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক লেখাপড়া সমাপ্ত করেন। ছাত্রজীবনেই বঙ্গবন্ধুর প্রাণের সংগঠন আওয়ামীলীগ এবং বাঙ্গালির মুক্তিকামী রাজনীতির নীতিতে, রক্ত স্নাত সংগ্রামী ভুমিকায় দূর্বল হয়ে পড়েন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জাগরণ বাঙ্গালির মনে-মননে যে সংগ্রাম শিহরিত হয়েছিল তার মধ্যে তারা মিয়াও তার একজন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময় থাকার কারণে তিনি বি,এ ভর্ত্তি হয়ে আর লেখাপড়া হয়নি। অত্যন্ত মেধাবী, সদা হাস্যজ্বল, সৎ, নিষ্ঠাবান ডানপিটে এ ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই দেশমাতৃকার জন্য ছিল দূর্বার। লেখা পড়ার সুবাধে তারা মিয়া চাদঁভাগ এলাকায় সর্ব প্রথম ইরি ধান ফলানোর উদ্ভাবক ছিলেন। কলের গান আর রেডিও বাজানো ছিলো সবচেয়ে প্রিয় সখ। এলাকায় প্রথম রেডিও এর প্রবর্তক ও তিনিই। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার বয়স ছিল প্রায় ত্রিশ বছর। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে বিহ্বল হয়েছিল হৃদয়। স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীনতার। নিজেকে নিজ হতে নিয়জিত করতে চাইলেন দেশ মাতৃকার মহান যুদ্ধে। ভীত সম্ভ্রন্ত হয়ে বসে থাকার চেয়ে নিজেকে আত্মনিয়োগ করলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে নিজ খরছে রান্না খাবার নিয়মিত পৌছে দিতেন তারা মিয়া। নিয়মিত পাকবাহিনীর অবস্থান ও পৌঁছাতেন মুক্তি শিবিরে। গ্রামের লোকজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভীতসম্ভ্রন্ত প্রতিবেশীদের অভয় দিতেন। যুদ্ধকালীন খবরা খবর শুনানোর জন্য রেডিও হাতে রাতের অন্ধকারে এ ঘর ও ঘর রওয়ানা হতেন । খড়খুটা রাখা ঘরে লুকিয়ে বসে খবর শুনাতেন ঘনিষ্ঠ জনকে। এসব তথ্য জেনে যায় স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানের ধূসর স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কর্মীরা। খুঁজতে থাকে তারা মিয়াকে। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার সকালে তার নিজ বাড়ি হতে স্থানীয় রাজাকাররা ধরে নেয় তারা মিয়াকে। এটাই ছিল তার শেষ যাত্রা। রাজাকারের বাড়ি নিয়ে হাত পা বেধে নির্মমভাবে নির্যাতন চালানো হয়। রাজাকার বাহিনীর বাড়ি পর্যন্ত পৌছে অনেক কান্নাকাটি করেছেন তারা মিয়ার সাত বোন সহ পরিবারের সবাই। কিন্তু ওদের কাছ থেকে মুক্ত হতে পারেননি। পাশবিক নির্যাতন শেষে বন্দি করা হয় মৌলভীবাজার কেন্দ্রীয় কারাগারে। এর পর হতে আর খুঁজ মেলেনি আট দিন। ষোল ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে লাশ হয়ে নিজ বাড়ি পৌছেন তারা মিয়া। স্বাধীনতার জন্য পাগলপারা তারা মিয়া দেখতে পাননি স্বাধীন সূর্যোদয়। জানা যায় ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ মঙ্গলবার মৌলভীবাজার কেন্দ্রীয় কারাগারেই গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। একাধিক তথ্য সুত্রে জানা গেছে- ২০১২ সালের ১১ ফেব্র“য়ারী মুক্তিযোদ্ধকালীন ইতিহাস সংরক্ষণে শহীদ তারা মিয়া নামে রাজনগর উপজেলার তালিকা সংরক্ষণ আছে । জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব আজিজুর রহমান স্বাক্ষরিত। মুক্তির নেশা আর চঞ্চল মনের প্রবাহমান সময় তৎকালীন পাক রক্তবীজের ধূসররা মুক্তির চুড়ান্ত বিজয় দেখতে দেয়নি তারা মিয়াকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামীলীগে সে সব রাজাকারের নাতী-পূতিরাও আজ আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে স্বেচ্ছার। প্রয়াত সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর প্রস্তাবিত শহীদ তারা মিয়া স্মরণে একটি পাকা রাস্তা নামকরণে নির্মাণ করার কথা থাকলেও সময়ের বিবর্তমান ধারা আর কোন্দলপূর্ণ রাজনীতির যোগসাজসে তা আর হয়ে উঠেনি। শহীদ তারা মিয়া নামকরণে একটি স্মৃতি গেইটের আবেদন করা হলে তাও সম্ভব হয়নি ।