সাংবাদিকতার সাড়ে তিন যুগ-আট

১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রিয় কমিটির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক বদিউর রহমান আমাদের জন্য অর্ধেক ভাড়ায় ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করে চিঠি লিখে পাঠালেন। সেমতে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি আটঘরিয়া শাখার সভাপতি হিসেবে আমি এবাদত আলী, সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম রাঙা, সদস্য এইচকেএম আবু বকর সিদ্দিক, মোহ্মাদ ইয়াছিন, এস দাহার মাতলু, হাসান আলী, পাবনা জেলা শাখার সদস্য আ.জ.ম. আব্দুল আউয়াল খান, আব্দুল কুদ্দুস চাঁদুসহ আরো অনেকে বাড়ি থেকে বের হয়ে মটর গাড়িতে চেপে ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনে গেলাম। বিশ্বাস কোম্পানীর মটর গাড়ি যেন মুড়িরটিন। তার আবার দুটি দরজা। ড্রাইভিং সিটের পরেই লোহার রড দিয়ে ঘিরে প্রথম শ্রেনীর কেবিন। এর পর দ্বিতীয় শ্রেনী। অবশিষ্ট সিটগুলি থার্ড ক্লাশ। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেনীর ভাড়া একটু বেশী। এভাবেই আমরা ঈশ্রদী পৌঁছলাম।

ঈশ্বরদী বাস ষ্ট্যান্ডের সাথে লাগোয়া রেলের টিকিট কাউন্টার। ঈশ্বরদী রেল ষ্টেশনে গিয়ে অর্ধেক ভাড়ায় ঈশ্বরদী থেকে ঢাকা পর্যন্ত টিকিট কেটে ট্রেনে উঠলাম। রাতের বেলা ট্রেনে চেপে ভোরে সিরাজগঞ্জ গিয়ে পৌছলাম। সেখান থেকে আমরা গেলাম দৈনিক সংবাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আব্দুল কুদ্দুস ভাইয়ের বাসায়। আমাদেরকে পেয়ে তিনি খুবই খুশি হলেন। এরপর সিরাজগঞ্জের অনেক সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপ পরিচয় হলো। আমরা সকলে মিলে সিরাজগঞ্জ স্টিমার ঘাটে গেলাম। এখান থেকেই স্টিমারে চেপে যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে জগনাথগঞ্জ ঘাটে যেতে হবে।
১৯১০ সালে ইশ্বরদী-সিরাজগঞ্জঘাট রেলপথ এবং সিরাজগঞ্জ স্টিমার ঘাট চালু হয়। তখন থেকে ঈশ্বরদী হতে ট্রেন এসে থামে সিরাজগঞ্জ ঘাটে। এরপর রেলওয়ে ফেরিতে করে যাত্রি ও মালামাল পারাপার করা হয় যমুনা নদীর ওপারে জগনাথগঞ্জ ঘাটে। সেখান থেকে পুনরায় ট্রেনে করে যাত্রি ও মালামাল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আমরা ঘাটে গিয়ে অপর একটি ট্রেনের আগমণের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কারণ ঈশ্বরদী থেকে আরেকটি ট্রেন না আসা পর্যন্ত ঘাটে অপেক্ষমান রেলওয়ে স্টিমার কিছুতেই ছাড়বেনা। একসময় ট্রেন এলো। আমরা আগেভাগেই স্টিমারের ক্যাবিনে উঠে বসেছিলাম। তাই স্টিমারে চড়ার জন্য কোন হুড়াহুড়ি করতে হলোনা। দেখতে দেখতে যাত্রিদের ভিড়ে স্টিমারের খোলস ভর্তি হয়ে গেলো। একসময় বিকট শব্দে সিটি বাজিয়ে স্টিমার ছেড়ে দেয়া হলো। উপরে উঠতি বেলার সুর্যের তাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ক্যাবিনে জলীয় বাষ্পে ভরা মৃদু শীতল বাতাস। সামনে বিস্তীর্ণ দিগন্তরেখা। নিচে যবুনা বা যমুনার বিশাল জলরাশি। স্রোতের দোলায় সাঁতার কেটে যেন দুলতে দুলতে পথ চলা। দারুন মোহনীয় এক্ষণ। ব্রহ্মপুত্র নদের প্রধান অববাহিকা খরস্রোতা রাক্ষুসি ও সাতিশয় বেগবতি এবং ভাঙনশিলা হিসেবে সমধিক পরিচিত এই যমুনা নদী। হিন্দু বিশ্বাস মতে এককালে শ্রীকৃঞ্চ ও রাধিকার প্রেম লীলা নিকেতন ছিলো এই যমুনা। বর্ষাকাল ব্যতীত এই নদীর পানি নীলাভ দেখা যাওয়ায় সেকালে ইংরেজ সাহেবগণ এই নদীর নাম দিয়েছিলেন ব্লু রিভার।
এই যমুনা নদীতে একটি সেতু নির্মাণের দাবী রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিনাঞ্চলের অধিবাসীদের। শুধু তাইনা, উপমহাদেশের এই অংশের জনগণ সর্বদাই বিশাল এই যমুনা নদীর ওপর দিয়ে সেতু স্থাপনের মাধ্যমে গোটা দেশের সঙ্গে এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সমন্বয়ের আকাঙ্খা পোষণ করে আসছে। ১৯৪৯ সালে জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রথম রাজনৈতিক পর্যায়ে যমুনা সেতু নির্মাণের দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৫৪ সালে পুর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে এই সেতু নির্মাণের কথা অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ১৯৬৪ সালের ৬ জানুয়ারি রংপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাইফুর রহমান যমুনা নদীর ওপর সরকারের সেতু নির্মাণের কোন ইচ্ছা আছে-কিনা জানতে চেয়ে প্রাদেশিক পরিষদে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। ১৯৬৬ সালের ১১ জুলাই রংপুর থেকে একই পরিষদের আরেকজন সদস্য শামসুল হক এই সেতু নির্মাণের জন ্যএকটি প্রস্তাব পেশ করেন এবং এটি সর্ব সম্মক্রিমে গৃহীত হয়।
১৯৬৯ সালে যুক্ত রাজ্যের ফ্রিম্যান ফক্স অ্যান্ড পার্টনার নামে একটি প্রতিষ্ঠান সেতুটির প্রাথমিক সম্ভ্যাব্যতা নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করে। তারা সিরাজগঞ্জের নিকট আনুমানিক ১৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে একটি রেল-কাম সড়ক সেতু নির্মাণের সুপারিশ করেন।
অন্যদিকে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের প্রক্কালে বেতার- টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দলের নির্বাচনী ওয়াদা হিসেবে যমুনা সেতু নির্মাণের কথা উত্থাপন করেন। এসকল প্রচেষ্টা তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মুক্তিযুদ্ধের কারণে বাস্তবায়িত হতে পারেনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭২ সালে যমুনা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয় এবং ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে এজন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ১৯৭৩ সালে যমুনা নদীর ওপর একটি সড়ক-কাম রেল সেতু নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা-সমীক্ষা হাতে নেয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার কারণে সব কিছু এলামেলো হয়ে যায়। যার কারণে আজো এই সেতু নির্মাণের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
যাক আমরা একসময় যমুনা নদী পার হয়ে জগনাথগঞ্জ স্টিমার ঘাটে গিয়ে পেীঁছলাম। অবর্ননীয় দুঃখ-দুর্দশা এতক্ষণ যেন শুধু আমাদের জন্যই ওৎ পেতে বসেছিলো। স্টিমার থেকে নামার পরপরই মিনি ম্যারাথন দৌড়ের প্রতিযোগিতা শুরু হলো। তাও আবার ধুধু বালুকণার মধ্য দিয়ে। এই প্রতিযোগিতা শুধু ট্রেনের কামরায় একটি সিট পাওয়ার জন্য। জগনাথগঞ্জ ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে একটি ট্রেন। সকলেরই লক্ষস্থল সেই ট্রেন। আগে যেতে পারলে তবেই সিট পাওয়া যাবে-নচেৎ দু পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে ট্রাফিকের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে যেতে হবে। আমাদের সঙ্গে কোন ভারি লাগেজপত্র ছিলোনা বলে রক্ষে নচেৎ কি যে হতো তা ভাবতেই দম বন্ধ হবার উপক্রম। যাদের সঙ্গে ভারি লাগেজপত্র, শিশু সন্তান কিংবা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তাদের অবস্থা বর্ণনা না করাই ভালো। আর রোগি সঙ্গে থাকলেতো মরার উপর খাঁড়ার ঘা। যাক আমরা সহি সালামতে জগনাথগঞ্জ ঘাটে দন্ডায়মান ট্রেনের কামরায় গিয়ে বসলাম। ট্রেন সরিষাবাড়ি হয়ে জামালপুর রেলওয়ে জংশন এবং সেখান থেকে ময়মনসিংহ জংশনে গিয়ে পৌঁছলো। ময়মনসিংহ হতে ট্রেন বদল করে ঢাকাগামি ট্রেনে চেপে একসময় আমরা ঢাকার ফুলবাড়ি রেল ষ্টেশনে গিয়ে পৌঁছলাম। স্টেশন থেকে রিকসা যোগে অগত্যা নবাবপুর রোডের একটি হোটেলে গিয়ে উঠলাম।
সমিতির পাবনা জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ যথা সাংবাদিক-অ্যাডভোকেট রণেশ মৈত্র, আনোয়ারুল হক, রবিউল ইসলাস রবি, হাসনাতুজ্জামান হীরা মির্জা শামসুল ইসলাম, আব্দুল মতীন খান শিবজিত নাগসহ অন্যান্য সাংবাদিকগণ সড়ক পথে আগেই ঢাকা পৌঁছেছিলেন।
পরদিন বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন ও নির্বাচন। আমরা সকাল সকাল সম্মেলনস্থলে গিয়ে হাজির হলাম। ঢাকা জেলা ক্রিড়া সমিতি মিলনায়তনে সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্টিত হবে তাই ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। প্রধান অতিথি হিসেবে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। কিন্তু তিনি উপস্থিত না হয়ে তথ্যমন্ত্রী আনোয়ার জাহিদকে পাঠালেন। তথ্যমন্ত্রী সম্মেলনের উদ্বোধন করলেন এবং ভাষণ দিয়ে জরুরি কাজের কথা বলে চলে গেলেন। সম্মেলনে কেন্দ্রিয় ও জেলার নেতৃবৃন্দ জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিলেন। দুপুরের খাবার শেষে দ্বি-বার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এতে সফি উদ্দিন আহমেদ সভাপতি এবং বদিউর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। সম্মেলন শেষে আমরা আবার ট্রেন পথেই বাড়ি ফিরে আসি।
সাংবাদিক হিসেবে ইতোমধ্যে আমাদের বেশ পরিচিতি ঘটেছে। আমরাও এলাকার বিভিন্ন ঘটে যাওয়া ঘটনা, অভিযোগ সমূহ এবং এলাকার সমস্যাবলি অতি গুরুত্ব সহকারে পত্র-পত্রিকার পাতায় তুলে ধরতে থাকি। তবে আমাদের পাঠানো খবর পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হলেও এলাকার সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যেতো। কারণ সেসকল পত্রিকার একটি কপিও এলাকায় আসতোনা। যে সাংবাদিক যে পত্রিকায় খবর পাঠাতেন সেই সকল সাংবাদিকদের নিকট ডাক যোগে কেবল সৌজন্য কপি পাঠানো হতো। অর্থাৎ ভাবখানা যেন এমনি ‘ মামারাই রাঁধে-বাড়ে মামারাই খায়, আমরা গেলে মামারা ঘরে দোর দেয়’ এই প্রবাদ বাক্যের মতই যেন অবস্থা। কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন খবর প্রকাশিত হলে তা জানতো কেবল এলাকার সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকেরা। এছাড়া আর কারো জানার উপায় ছিলোনা। তবে কোন কোন সাংবাদিক এলাকার লোকজনের কাছে গল্প করতেন আর সেকথা চলে যেতো সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তা ব্যক্তির নিকট। তিনি তখন হন্যে হয়ে খুঁজতেন সেই সকল পত্রিকা। কেউ কেউ আবার প্রেসক্লাবে গিয়ে পত্রিকার খোঁজ করতেন। (ক্রমশঃ)।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
বাসা: টেবুনিয়া, পাবনা।
মোবাইল: ০১৭১২২৩২৪৬১