আজ শিলার মনটা খুব খারাপ। কোন কিছুই ভালো লাগছে না তার। বেশ কয়েকদিন হলো ক্লাসেও মন বসাতে পারছেনা সে। তাই ক্লাস করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। ডিপার্টমেন্টে গেলেই সবাই কেমন যেন কানাকানি করে। দু একজন টিপ্পন্নী ও কাটে। তাই এই নীরবতা। কিন্তু স্যার আসছে না কেন? কি হয়েছে তার? মোবাইল ফোনটাও বন্ধ। এ ধরণের অনেক প্রশ্ন মনে জাগছে শিলার। শিলা আর ভাবতে চায় না। স্যার তো বিবাহিত। সে বরং বন্ধু বান্ধবীদের সাথে ফুর্তি করবে তাদের সাথেই মিলে মিশে থাকবে। পড়াশুনায় ভালো হওয়ার সুবাদেই তাকে সবাই খুব গুরুত্ব দেয়।
নোয়াখালীর তালতলী গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষকের ছেলে আনোয়ার। জীবনে অনেক কষ্ট সয়ে, বাড়ী বাড়ী ছাত্র পড়িয়েও ভালো ফলাফল করে। পারিবারিক পছন্দে কালো ধনীর দুলালী মেয়েকে বিয়ে করে। সত্যিকার অর্থে কালো বউ তার পছন্দ না। তাছাড়া বউ বড়লোকের মেয়ে, দম্ভ বেশি। একটু গড়মিলেই বিভিন্ন জিনিসের খোটা দেয়। বিয়ের শুরু থেকেই এই সমস্যার মধ্যে দিয়ে চলতে হয় তাকে। তাদেও ঘরে জন্ম নেয় একটি শিশু। আনোয়ার সাহেব ভাবেন, এবার বোধ হয় তার স্ত্রী একটু হলেও সংসারে মনোযোগী হবে। কিন্তু না। বউয়ের খবরদারী চলতেই থাকে। আনোয়ার সাহেব ও দিন দিন বেপরোয়া হয়ে যান। ক্লাসের সুন্দরী মেয়ে তার প্রধান আকর্ষণ। বেশী নম্বর ও ক্লাসে ফাস্ট হওয়ার জন্য অনেক মেয়েই শিক্ষকের দড়জায় কড়া নাড়ে। শিক্ষকরাও বিভিন্ন ভাবে সুযোগ নেয়। শিলা এই সুযোগ প্রত্যাশীদের মধ্যে একজন। শিলার রেজাল্ট বরাবরই ভালো। তাই অনেক স্বপ্ন তার। ভালোভাবে খেটে খেটে খুটে পড়ে স্যারদের সাথে মিশে যদি আরো ভালো রেজাল্ট হয়, তাহলে জীবনে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। শিলার পারিবারিক অবস্থা ও ভালো না। তার জন্য বাবা-মাকে কত দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। ভালো জামা কাপড় এর আবদার ও মেটাতে পারে নি বাবা মা। অবশেষে তার আগ্রহ দেখে বড় মামা পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়েছে। বড় মামার ইচ্ছা, শিলাকে তার বড় ছেলের বউ বানাবে। কিন্তু শিলা সে সব মানতে রাজি না। মামার অর্থে তাদের হক আছে। প্রয়োজনে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মায়ের অংশটা ছেড়ে দিবে। কিন্তু মামাতো ভাইকে বিয়ে করতে পারবে না। মামাতো ভাই সেই কবে ম্যাট্রিক পাশ করে পুলিশ হয়েছে। শিলা তাকে বড় ভাই হিসাবেই জানে। কিন্তু সেও বড় কথা নয়। অর্থ ও সম্মানে আনোয়ার সাহেব অনেক উপরে। তাছাড়া শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা ডিপার্টমেন্টের বিশেষ সুবিধা ভোগ করে। সেটা যাই হোক, বিচার হোক আর অবিচার হোক ফাস্ট ক্লাস গুলো অধিকাংশই তাদের ভাগ্যেই লেখা থাকে। প্রয়োজনে অন্য বছরগুলোতে ফাস্ট ক্লাস বন্ধ রাখা হয়। শিলা এই ভাগ্যের জোড়ের স্বপ্ন দেখে। এই বিশাল পৃথিবীতে সবাই স্বপ্ন দেখে। তাছাড়া শিলা ও আনোয়ার সাহেব দুজনেই দুজনের প্রেমে বিভোর। তারা সামাজিক অবস্থানের কথা ভাবছে না।
আজ ছুটি। অলসভাবে শুয়ে আছে শিলা। কোন কিছুতেই মন বসছে না তার। হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠে। শিলা বেশ অভীমানী হয়ে আছে। ছুটির দিনে ওপাশ থেকে আনোয়ার সাহেব চেম্বারে ডেকে বসেন। শিলাকে এই রকম অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। অনেকের মুখেই স্যারের কতো কত কথা শুনেছে সে। কিন্তু মন মানে না। কয়দিন পরে গ্রীষ্মের ছুটি জেনে মামা শিলার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে তার ছেলের বিয়ের কথা পাকা করে। কিন্তু শিলা এ বিয়েতে রাজি নয়। মা বাবা বুঝতে চায় না যে, শিলা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় । বাবার এক কথা ভাইজানকে কি জবাব দেব? কখনো কখনো শিলাকে বলেই ফেলে, তোর জন্য ভাই জানের নিকট থেকে কত টাকা নিয়েছি তার হিসাব আছে? বিয়ে অবশেষে বিয়ে টা যদি না হয় তাহলে আমি পরকালে ঠেকে যাবো।
এক কাক ডাকা ভোরে ঢাকার উদ্দ্যেশে রওনা হয় শিলা। কমলাপুর রেলষ্টেশনে নেমে ভাবছে কোথায় যাবে। ভাবে, রাগের মাথায় এইভাবে বের হয়ে আসাটা ঠিক হয় নি। ঢাকায় কোন আত্মীয়-স্বজন ও নাই। হঠাৎ দেখে সামনের ভীড় ঠেলে রেবেকা আসছে। শিলা, এই শিলা বলে ডাকতে ডাকতে শিলার কাছে চলে আসে রেবেকা। আরে তুই ? এখানে কার সাথে এসেছিস? কোথায় যাবি? গ্রামের সেই নদীর ওপারের অল্প শিক্ষিত মেয়ে রেবেকার আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয় শিলা। বুবু তুমি এখানে? বাড়ির সবাই কেমন আছে? শিলা চুপ থাকে। শিলার মন খারাপ দেখে রেবেকা বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে। ঠিক আছে পরে শোনা যাবে। চল, আমার বাসায় চল। বাসা মানে যেখানে রেবেকা তার মেয়েদের নিয়ে একত্রে থাকে।
রেবেকোর বাড়ির পরিবেশটা শিলার ভালোই লাগে। অনেক ভেবে শিলা সিদ্ধান্ত নেয় অন্য কিছু যদি না জোটে তবে গার্মেন্টেসে হলেও কাজ করবে সে। রেবেকা তাকে বাড়ী ফিরে যাওয়ার জন্য অনেক বোঝায়। কিন্তু শিলা তার সিদ্ধান্তে অটল। বড় হওয়ার স্বপ্নটা মিথ্যে হতে দেবে না সে। এক সময়ে গার্মেন্টেসে অফিসার পদে চাকরি পায় সে। এরি মধ্যে মাস্টার্স পরীক্ষায়ও পাশ কওে সে। অন্য চাকরির চেষ্টা করে। বাবা-মার জন্য টাকা পাঠায়। শিলার ঠিকানা পেয়ে মা-বাবা, ছোট ভাই ঢাকায় চলে আসে। ঠিক পরের দিন ব্যাংকের চাকুরির অ্যাপোয়েনমেন্ট লেটার ও হাতে পায় শিলা। খুশিতে সবার চোখে জল চলে আসে। রেবেকাও একদিন ছোট একটি বাচ্চাকে নিয়ে স্বামীর ঘর থেকে চলে এসেছিল। তার গরীব বাবা যৌতুকের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় শ্বাশুড়ী অত্যাচার করতো। হাতে টাকা পয়সা না থাকলে স্বামী ও মারধর করতো। অবশেষে সংসার ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
শিলার একটা মেয়ে এখন বেশ বড় হয়েছে। নানা-নানীর সংসারে থাকে সে। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক বৃত্তি ও পেয়েছে। রেবেকার অনেক স্বপ্ন তার মেয়ে ও শিলার মতো ভালো একটা চাকরি করবে। সে তো অনেক কষ্ট করে এখানে পরে আছে। জীবনের অনেক সাধ আহŸলাদ কে কবর দিয়ে এই কারখানার যন্ত্রগুলোর মতোই তার জীবনের পথ চলছে। অধিক শ্রম কিন্তু পারিশ্রমিক কম। অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে। যে মাসে ওভার টাইম কাজ করে সে মাসে কিছু বেশি টাকা মেলে কিন্তু, ওভার টাইম কাজ বেশি করতে পারে না। নিচু হয়ে কাজ করতে করতে ঘাড়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এই চাকরি ছাড়া তো আর বাঁচার উপায় নেই।
কয়েক বছর পরের কথা। শিলা এখন নোয়াখালীতে থাকে। নিজ গ্রামের এক প্রভাবশালীর ছেলেকে বিয়ে করেছে প্রায় দুই বছর হলো। কিন্তু সন্তানাদী হয়নি এখনও। স্বামী স্ত্রী একই সাথে একই অফিসে চাকরি করে। মন চাইলে রান্না করে। না হলে বাহিরে খায়। এছাড়া অনান্য কাজগুলো তার ইচ্ছেমতোই করে। সংসারে তার মতামতের যথেষ্ট দাম আছে। বাবা মাকে ও সাহায্য করতে পারে। সব মিলিয়ে সমাজের ৯০ ভাগ মেয়েই তার অবস্থানে নেই। দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন মার্কেটে আনোয়ার সাহেবের সাথে দেখা। কয়দিন পরে আনোয়র সাহেব সোজা গিয়ে ব্যাংকে হাজির। দুপুরের খাওয়ার বিরতি চলছিল। পাশের হোটেলে খেতে-খেতে অতীত দিনের ফেলে আসা অনেক কথাই হলো। আনোয়ার সাহেব এখন নীড় হারা পাখির মতো জীবন যাপন করছেন। কিন্তু শিলা বেশ সুখেই আছে। সে আর পেছনে ফিরে তাকাতে চায় না। সুখ আনন্দের মধ্য দিয়েই দিন কাটছিল।
প্রায় মাস ছয়েক হলো শিলার একটি সন্তান হয়েছে। এতে তার সংসারে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। শিলার স্বামী আসাদ চায়না যে, শিলা চাকরি করুক। ছেলেটার শরীর ও ভালো যায় না। কাজের মেয়েটা অযতœ করে ভেবে সন্দেহ হয়। তার আর্থিক কেন সমস্যা নেই। ছেলেকে যদি মানুষই করতে না পারে তাহলে টাকা রোজগার করে লাভ কি? তাই চাকরি ছাড়ার জন্য শিলাকে চাপ দিতে থাকে। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং স্বনির্ভরতার জন্য, সমাজিক মর্যাদার জন্য চাকরির দরকার আছে। কিন্তু ছেলেটার জন্য নানান তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে শিলা চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। জীবনের চলার গতিতে জোয়ার- ভাটা খেলা করে। চাকরি ছাড়ার পর থেকে হাতে নগদ টাকা তেমন থাকে না। ছোট ভাইটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার লেখা পড়ার খরচ শিলাই দিত। এতে আসাদের কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু চাকরি ছাড়ার পরে মাস চারেক আসাদ সেই দায়িত্ব পালন করেছে। শিলা কষ্ট পেলেও কর্তব্যটা আর করতে পারে না। তাই মনটা খারাপ থাকে। মনে মনে ভাবে চাকরিটা ছেড়ে দেওয়াটা তার ভুলই হয়েছে? মা-বাবা তার জন্য কতটা কষ্ট পেয়েছে। আর সে শুধু নিজের সুখের কথাই ভাবল। ছোট ভাইয়ের কথা স্বামীকে বলতে ও ভালো লাগে না। নিজেকে নিজের কাছে খুব ছোট মনে হয়। এসব ভেবে চোখে জল আসে তার। তাছাড়া গ্রামে ফসল তোলার সময় হাড়ভাঙ্গা খাটুনি ও করতে হয়। তবুও কারো মন পাওয়া যায় না। যদিও গার্হস্থ্য বাড়ির অনেক কাজই তার অজানা ছিল। চাকরি ছাড়ার পরে বাড়িতে কাজের ঝি টাকেও তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে জীবনটা বিষিয়ে উঠেছে। সময় বদলানোর সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের জীবন যাত্রার ও পরিবর্তন ঘটে। আসাদ ও এখন অনেক বিষয়ে স্ত্রীর সঙ্গে সহমত পোষণ করে না। প্রায়ই অশান্তি হয় । কিন্তু শিলা সমাজের কারো কাছে বোঝা হতে চায় না। জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মতো বুকে কাঁটা নিয়ে বাঁচতে চায় না। শিলা মায়ের বাড়ি চলে যায়। আবার নতুন করে চাকরির চেষ্টা করে।
জমানো কিছু টাকা নিয়ে এম.ফিলে ভর্তি হয় শিলা। কুসংষ্কারাচ্ছন্ন সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মাথা উচুঁ করে বাঁচতে চায় সে। ভালো লাগে শিলার আত্ম-প্রত্যয় নিয়ে স্বপ্ন দেখার। ভাবে বেঁচে থাকার দৃঢ়তা যার প্রবল সে জয়ী হবেই। ঘুড়ে দাড়ানোর চেষ্টা করে এক তেজস্বী শিলা।