বেশ কিছু একাডেমিক গ্রন্থ আমি লিখেছি ইংরেজি গ্রামার ও সাহিত্যের উপরে। কাজেই প্রকাশনা জগত সম্পর্কে আমার কম বেশি ধারণা আছে। একাডেমিক গ্রন্থ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ক্রয় করে। বুকে বড় আশা নিয়ে আমার এক পরিচিত প্রকাশকের কাছে গেলাম একটি কবিতার বই ছাপাবো বলে। তার কথা শুনে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। তিনি আমাকে যা শোনালেন তা রীতিমত ভয়ংকর। তিনি ছাপ জানিয়ে দিলেন কবিতার বই মানুষ কিনে না, তাই তিনি ছাপাতে রাজি নন। তিনি নিজ খরচে ছাপানো ও বিক্রির পরামর্শ দিলেন। হতাশ হয়ে ফিরে এলাম বাসায়। কিন্তু কেন মানুষ কবিতার বই কিনে না সেই প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো। জরিপ করতে শুরু করলাম। যেহেতু আমি কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াই তাই জরিপ কাজটি আমার জন্য সহজ ছিল। ছাত্র ছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করলাম তারা কবিতার বই পড়ে কিনা বা কিনে কিনা। বেশিরভাগ উত্তর দিলো কবিতা পড়তে তাদের ভাল লাগে না। হেতু হিসাবে তারা আমাকে জানালো যে আধুনিক কবিতা পড়ে তারা কোন মজা পায় না, কোন ছন্দ খুঁজে পায় না, কবিতার ভাষা তারা বুঝে না। তাদের যুক্তিগুলি আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। তাদের কথাগুলি ফেলে দেয়ার মত ছিল না। কেননা কেউ যদি কোন কিছু পড়ে বুঝতে না পারে তবে কেন সে টাকা দিয়ে তা কিনবে। অনুসন্ধানের আগ্রহ আমার আরও বেড়ে গেলো। শুরু করলাম আধুনিক কিছু কাব্য নিয়ে স্টাডি। অনেক গুলি বিষয় আমার নজরে এলো। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। অন্যের চিন্তার সাথে নাও মিলতে পারে। পাঠক সরে যাওয়ার পিছনে আমি নিন্মোক্ত হেতু গুলি খুঁজে পেয়েছি
১. মানহীন লেখা।
২. ভাষার জটিলতা
৩. ছন্দের অভাব
৪. সঠিক মাত্রা বিন্যাসের অভাব
৫. অন্তঃসারশূন্য বিষয়বস্তু
৭. লেখার মান যাচাই না করেই নির্বিচারে কবিতার বই ছাপানো
৮. মিডিয়া কাভারেজ কাঙ্খিত পর্যায়ে না পাওয়া
৯. যে তেনো লিখে বড় কবি হওয়ার বাসনা
১০. লেখার মৌলিকত্বের দিকে নজর না দেয়া
১১. কাব্য আন্দোলন তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া
১২. যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কাব্য রচনা করতে না পারা।
১৩. কবিতা পড়া নয়, শুধু লিখে কবি পরিচিতি নেয়ার বাসনা।
১৪. ছাপানো সব বই সৌজন্য দিয়ে নিজেকে কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থ চেষ্টা
১৫. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কবিতা লিখে রাতারাতি কবি হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।
আরও অনেক কারণ আছে। সেগুলির দিকে নাই বা গেলাম। William Wordsworth রোমান্টিক যুগের শুরু করলেন যা সাহিত্যের এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিলো। তার মূল কথা ছিল কাব্যিক ভাষা হবে সহজ সরল যেন সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারে। তাল নাই, লয় নাই, ভাষার মাধুর্য নাই, সারসত্তা নেই এমন কাব্য কেউ রচনা করলে তা কাব্য হয়ে উঠবে না। যে কাব্য পাঠক হৃদয়ে নাড়া দিতে পারে না সে কাব্য মানুষ বর্জন করে। আজ কাব্য জগতে খড়া চলছে। কবিদের কর্মকাণ্ড দেখে কি বলবো তা ভেবে পাই না। বর্তমানে হাজার হাজার অন লাইন কাব্য পরিষদ। সহজভাবে বললে প্রতি কবি ( কবি কিনা তা বিধাতা জানে) একটি করে গ্রুপ সৃষ্টি করেছেন। কেউ কেউ আবার ৩/৪ টি ও করেছেন। বাহারি পদের নাম আর রংচং এ কাব্য কতটুকু চর্চা হয় তা বলা মুশকিল। কবিতা গ্রুপগুলি সদস্য বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। কবিতার মান তো দূরের কথা, নিজের মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যায়। কবিতা না পড়ে কপি পেস্ট মন্তব্য করার যে হিড়িক প্রতিটি গ্রুপে চলে তা এখন ওপেন সিক্রেট। আর এ ধরনের মন্তব্য পেয়ে পোস্ট দাতা কবি ( কবি কিনা বলা মুশকিশ) আবেগে ফেটে পড়ে এবং সর্বোচ্চ ভাষা প্রয়োগ করে কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকে। অনলাইন কাব্য গ্রুপ গুলি বছরে হয়তো একটি অনুষ্ঠান করে এবং আর্থিক অনুদান নিয়ে অথবা অন্য কোন উপায়ে একটি ক্রেস্ট হাতে ধরিয়ে দেয়। ক্রেস্টটি পেয়ে ( যদিও নিজ অর্থ ব্যয়ে) সে নিজেকে মহাকবি ভাবতে শুরু করে। মরীচিকার পিছনে ছুটে চলা এসব কবি কি আসলেই কবি? যৌথভাবে অনেক কাব্যগ্রন্থ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এতে কবির কি লাভ হচ্ছে? নিজের বই নিজের ক্রয় করতে হয়। অর্থাৎ কিছু কবির হাতেই বই ঘুরাফেরা করে, পাঠক সেটা কিনে পড়ে না। তবে একেবারে যে মানুষ কবিতার বই কিনে না তা কিন্তু নয়। ভাল মানের লেখা হলে কিনে পড়ে। প্রশ্ন হল লেখার মানের দিকে কজন নজর দিতে পারছেন। এবার আসি মিডিয়া কাভারেজ নিয়ে। অনেক কবির মানসম্মত লেখাও কালের গর্ভে হারিয়ে যায় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। মিডিয়া কাভারেজ না থাকলে পরিচিতি বাড়ে না। পাঠকেরা ঐ লেখকের লেখা সম্পর্কে জানতে পারে না। কবি শামসুর রহমান, কবি সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলুন্দ গুণ, এমদাদুল হক মিলন সহ অনেক কবি আছে যারা তাদের মৌলিক লেখার গুণে খ্যাতি পেয়েছেন। কিন্তু তারা সাংবাদিক হওয়াতে তারা সহজে মিডিয়া কাভারেজ পেয়েছেন। পাঠ্য বইতে কারও একটি কবিতা যুক্ত হলেতো কথাই নেই।
পাঠককে আবার সেই পূর্বের মত মনোযোগী করে তুলতে হলে কবিদের কিছু কাজ করতে হবেঃ
১. মৌলিক লেখা উপহার দিতে হবে।
২. ছন্দে লেখার চেষ্টা করতে হবে। কারণ ছন্দ কবিতা পড়তে সবার ভাল লাগে।
৩. সঠিক মাত্রা জ্ঞান নিয়ে কবিতা লিখতে হবে।
৪. সৌজন্য কপি দিয়ে কবি হওয়ার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
৫. পাঠকদের মাঝে কাব্য আন্দোলন তৈরি করতে হবে।
প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য সব লেখক, কবি চেষ্টা করে। কিন্তু সে চেষ্টাটার মাঝে যেন থাকে মেধার বিকাশ, সততা, মৌলিকত্ব ও ধৈর্য। সবাই নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের মত জনপ্রিয় হবে না। কিন্তু ভাল মানের লেখা উপহার দেয়ার চেষ্টা চালাতে হবে। যুগের চাহিদা অনুযায়ী কাব্য রচনায় ব্যর্থ হলে সে দায় কবিদের নিতে হবে। দু চারটি কবিতা লিখেই বই প্রকাশ করার একটি হিরিক লক্ষ্য করা যায় কবিদের মধ্যে। এ ধরনের মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোরও কিছু দায়িত্ব আছে এক্ষেত্রে। অনেক ভাল মানের লেখা চাপা পড়ে যায়, অথচ শক্ত যোগাযোগের কারণে অনেক সময় মানহীন লেখাও ছাপা হয়ে যায়। ফেসবুকে কাব্য চর্চার একটি অবাধ ক্ষেত্র। কিন্তু সেখানে লেখার মৌলিকত্ব দেখার কেউ নেই। যে যার মত করে লেখে যাচ্ছে। সবাই সস্তা এবং দ্রুত জনপ্রিয়তার পিছনে অবিরাম ছুটে চলেছে। যে সব প্রতিষ্ঠান গুলি সাহিত্যের সেবা করে তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। যোগ্য লেখাকে পুরষ্কৃত করা ও লেখককে সম্মান দেয়া তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমার নগন্য জ্ঞানে এতটুকু বুঝি যে মানসম্মত ও মৌলিক লেখা উপহার দিলে পাঠক সেটা লুফে নিবে। পাঠকদেরকে এত বোকা ভাবার কোন কারণ নেই। লেখক- কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা ।