যুবসংগঠন হবে প্রকৃত অর্থে যুবাদের স্বার্থ রক্ষা. সততার সাথে দেশপ্রেমিক একটি যুবসমাজ তৈরি ও দেশে যেকোন ষড়যন্ত্র মোকাবেলার জন্য ভ্যানগার্ড হিসেবে ভূমিকা পালন করার মত এটাই সকলের প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে বড় ও ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের যুবসংগঠনগুলো সেই প্রত্যাশা পূরণে কখনোই সফল ছিলনা।
গত ১৪ই নভেম্বর’২০ দেশের ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের পূর্নাঙ্গ কমিটি ঘোষনা করা হয়েছে। আশার কথা এই কমিটিতে ক্লিনইমেজের যুবকদের অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে নতুনভাবে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করলো বলে মনে হচ্ছে।
তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারনে দেশব্যাপী আওয়ামীলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতা জড়িয়ে পড়েছেন দুর্নীতি ও নানান অপকর্মে। দলের সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের সততার জোরে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার ঘোষনা দিয়ে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন দুই বছর আগেই।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালানো হলে বেরিয়ে আসে দুর্নীতির নানা খবর। এর মধ্যে তিন সংসদ সদস্যসহ ২৩ ব্যক্তির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। একে একে গ্রেফতার হন যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত বিতর্কিত ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ বেশ কয়েকজন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি-সম্পাদকও অপকর্মে জড়িত হওয়ার কারনে দলীয় প্রধান তাদেরকে বিদায় করে দিয়েছিলেন।
এভাবে শুদ্ধি অভিযানের ধারাবাহিকতায় যুবলীগের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনির সুযোগ্যপুত্র শেখ ফজলে শামস পরশ ও মাঈনুল হোসেন খান নিখিলকে। তাঁরা দুজন সংগঠনে শৃংখলা ফিরিয়ে এনে কমিটির সম্ভাব্য নেতাদের তালিকা উত্থাপন করেন। এই তালিকা বিবেচনা ও গ্রহনযোগ্যতা মূল্যায়ন করে দলীয় প্রধান অনুমোদন দিয়েছেন।
এই কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন কয়েকজন সংসদ সদস্য, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, বিভিন্ন জেলা থেকে ওঠে আসা নতুন মুখ, সিসি কমিটির সদস্য ও সাবেক কমিটির বেশ কয়েকজন। কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিকও।
নতুন কমিটিতে বাদ পড়েছেন যুবলীগের গত কমিটির বিতর্কিত নেতারা। পাশাপাশি বয়স ৫৫ বছরের বেশি হওয়ায় বাদ পড়েছেন ৭০ জনের বেশি।
প্রেসিডিয়াম সদস্যের পদ রাখা হয়েছে ২৭টি। এছাড়া সংগঠনের সভাপতি তার পদাধিকার বলে এই পর্ষদের সদস্য। এই ২৭টি পদের মধ্যে পাঁচটি পদ খালি রেখে বাকি পদগুলো ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রেসিডিয়ামের সদস্য পদে এসেছেন- অ্যাডভোকেট মোমিনুর রশিদ, মঞ্জুর আলম শাহীন, আবু আহমেদ নাসিম পাভেল, শেখ সোহেল উদ্দিন, ডা. খালেদ শওকত আলী, শেখ ফজলে ফাহিম, মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন (এমপি), ইঞ্জিনিয়ার মৃণাল কান্তি, তাজউদ্দিন আহমেদ, জুয়েল আরেং (এমপি), জসিম মাতব্বর, মো. আনোয়ার হোসেন, শাহাদাত হোসেন তসলিম।
এছাড়া কমিটিতে এসেছেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইদুল হক সুমনসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তি যাঁদের নিয়ে এখনো কোন বিতর্ক তৈরি হয়নি।
সুতরাং নবগঠিত যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে; দলীয় প্রধান শক্ত অবস্থানে আছেন। বিতর্কিতদের কোনভাবেই আবার কমিটিতে জায়গা দেননি। একই সাথে উদ্যোমি. সাহসি ও ভাল ইমেজের অনেককে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে দেশের যুবসমাজকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো-টলারেন্স নীতিতে অটল।
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ বাংলাদেশের প্রথম যুব সংগঠন যা ১৯৭২ সালের ১১ই নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। সংক্ষেপে যুবলীগ নামে সংগঠনটি বহুল পরিচিত। এটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুব অঙ্গসংগঠন। এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসে চেয়ারম্যান পদে শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক পদে মাঈনুল হোসেন খান নিখিল নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশে যুবকদের আর্থ-সামাজিক সমস্যা রয়েছে অনেক। বেকারত্ব তাদের কর্মশক্তি নষ্ট করছে। চলমান করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে নতুন নতুন সমস্যা যুবাদের ঘাড়েই চাপছে। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারলে শুধু সংগঠন দিয়ে তেমন কিছু পরিবর্তন হবেনা তাদের ভাগ্যের।
সংগঠনের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ একাধিকবার বলেছেন, ‘যুবলীগকে প্রকৃত অর্থেই তার উদ্দেশ্য-আদর্শের উপযোগী একটি সংগঠনে ফিরিয়ে আনা হবে। যুবসমস্যা সমাধানে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে সংগঠনটি’।
কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে নানান কাহিনি প্রচলিত আছে। বিশেষ করে জেলা-উপজেলায় স্বজনপ্রীতি. সুবিধার বিনিময়ে কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি কারবার তো আছেই। মুলদল ও অঙ্গসংগঠনে একই অবস্থা। এ কারনে কমিটিগুলোতে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি চলে আসার বহু উদাহরণ রয়েছে। এগুলোকে রাজনীতির ভাষায় বলা হচ্ছে ‘অনুপ্রবেশকারি’। সাম্প্রতিক সময়ে এই শব্দটি বহুল প্রচলিত। নানান অপকর্মে যারা প্রকাশিত হয়ে পড়ছে তাদের ক্ষেত্রে সহসায় বলা হয়ে থাকে, ‘এরা অনুপ্রবেশকারি’।
আসলে কি এরা নিজেরা প্রবেশ করেছিল-? নাকি কোন নেতার হাত ধরে দল-সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল-? পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিতে বিতর্কিতদের মুখোশ উন্মোচন হলেও যারা তাদেরকে ব্যক্তিগত সুবিধার বিনিময়ে এনেছিল তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোন ব্যবস্থা গ্রহনের উদাহরণ আমাদের রাজনীতিতে নেই। ফলে কথিত অনুপ্রবেশকারিরা এক সময় দল-সংগঠনের ভিতরে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র শুরু করে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা বুমেরাং হয়ে যায়।
যুবলীগ সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ উচ্চশিক্ষিত. মার্জিত. ভদ্র. নির্লোভ ও ব্যক্তিত্ববান একজন পরিপক্ক মানুষ। তিনি চেষ্টা করছেন সংগঠনকে বিতর্কের বাইরে একটি মর্যাদাশীল সংগঠনে ফিরিয়ে আনতে। এটা অসম্ভব কিছু নয়। সদ্যঘোষিত কেন্দ্র কমিটি মূল্যায়নে সেই প্রচেষ্টার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এখন এই ধারাটি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার উপরে নির্ভর করছে সামগ্রিকভাবে এর সফলতা। আশা করা যায় বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি আন্তরিক থাকলে দেশব্যাপী মাস্তান. দুর্নীতিবাজ. ধান্দাবাজ মুক্ত একটি যুবসংগঠন গড়ে উঠবে।
( লেখক: সিনিয়র সংবাদকর্মী ও সাবেক সভাপতি-ঈশ^রদী প্রেসক্লাব)। ১৬.১১.২০