নির্মল বড়ুয়া মিলন, রাঙামাটি জেলা প্রতিনিধি :: ১৯৬৬ সালে তৎকালিন সরকার জল বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরী লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করার ফলে কর্ণফুলী বা কাপ্তাই হৃদের সৃষ্টি হয়।
শুরুতে কাপ্তাই হৃদ রাঙামাটি জেলাবাসির জন্য কষ্টের কারণ হলে বর্তমান এ হৃদ জেলাবাসির জন্য আশির্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাঙামাটি জেলায় কাউখালী ও রাজস্থলী উপজেলা ব্যতিত বাকি আটটি উপজেলার প্রায় সকল ধরনের যোগাযোগ ও যাতায়ত ব্যবস্থার মাধ্যম হচ্ছে নৌপথ।
রাঙামাটি সদর, বরকল, কাপ্তাই, জুরাছড়ি, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও নানিয়ারচর উপজেলায় মৎস্য চাষ, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি-অফিস, স্কুল-কলেজ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের একমাত্র যাতায়ত মাধ্যম নৌপথে করিতে হয়।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাপ্তাই হৃদ অবৈধ দখল ও দুষণ মুক্ত ছিলো। ১৯৮১ সালের দিকে কাপ্তাই হৃদের পাড়ে অবৈধ দখলদারদের বসতি স্থাপন এবং হৃদ দুষণ শুরু হয়।
২০২০ সালে এসে কাপ্তাই হৃদের ওপর লক্ষাধিক অবৈধ স্থাপনা এবং হৃদের দুষণ অতিরিক্ত মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বরকল, কাপ্তাই, জুরাছড়ি, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, নানিয়ারচর ও রাঙামাটি শহরে অবৈধভাবে কাপ্তাই হৃদের জায়গা দখল করে প্রভাবশালি মহল গড়ে তুলেছে হোটেল, মোর্টেল, সুপার মার্কেট, সরকারি-সে-সরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ, ক্লাব ঘর, রাজনৈতিক অফিস, ব্যবসায়ীক বহুতল ভবন, আবাসিক ভবন, আদা পাকা স্থাপনা ও কাঁচা ঘর-বাড়ি ইত্যাদি।
নিয়মনীতি কোন ধরনের তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালি মহল অনেক স্থানে কাপ্তাই হৃদের অবৈধভাবে দখল করে তাতে মাটি ভরাট করে স্থাপনা নির্মান ভোগ করছে রাষ্ট্রের সম্পদ।
অবৈধ ভাবে হৃদ বা লেক দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটিতে আলোচনা হলেও ক্ষমতাসীন প্রভাবশালি মহলের চাপে স্থানীয় প্রশাসন হৃদের জায়গা এবং হৃদের পাড় দখলদারদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করতে অদ্যবধি পারেনি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত তিন বছরে পাল্লা দিয়ে রাঙামাটি শহরে কাপ্তাই হৃদের ওপর গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার বহুতল ভবন।
অথচ বাংলাদেশ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিত তালিকায় কর্ণফুলি নদী (কাপ্তাই হৃদ) দুষণমুক্ত,অবৈধদখল/স্থাপনা নাই এবং নদীর তীরে কোন বাজার/শিল্প কারখানা নাই বলে উল্লেখ করেছে।
এসব দেখার জন্য রাষ্ট্র বা সরকার স্থানীয় ভাবে যে সব প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও কাপ্তাই হৃদের জায়গা দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এবিষয়ে জানতে বাংলাদেশ জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান (সরকারের সচিব) ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদারের মুঠেফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি ফোন রিসিভ করে দুপুরের খাওয়ার কথা বলে কিছুক্ষণ পরে যোগাযোগ করিতে বলেন, তার পরে তিনি আর ফোন রিসিভ না করায় কর্ণফুলি নদীর বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় নদী কমিশনের উল্লেখিত মন গড়া তথ্য প্রদানের বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি।
এবিষয়ে রাঙামাটি বিএফডিসির ম্যানেজার কমান্ডার তৌহিদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি জানান কণুফুলী নদী ও কাপ্তাই হৃদে অসংখ্যক অবৈধ দখলদার এবং লক্ষধিক অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। কর্তৃপক্ষের উদাসিনতার কারণে অবৈধ দখলদার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ সম্ভব হচ্ছে না।
রাঙামাটি বিএফডিসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলন, আমাদের অফিসের কাছাকাছি গর্জনতলী এলাকায় প্রভাবশালিরা নদীর ওপর অবৈধভাবে ক্লাব ঘর নির্মান করেছে, আমরা বাঁধা দেয়ার কারণে প্রভাবশালিরা আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে অনেক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এখানে চাকুরী বাঁচানো ফরজ বলে তিনি জানান।
কণুফুলী নদী ও কাপ্তাই হৃদে দুষণ,অবৈধ দখল/স্থাপনার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী উপকেন্দ্র রাঙামাটির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আজহার আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে, “হৃদে মৎস্য সম্পদ নিয়ে গবেষণার কাজ” বলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন।
হৃদ বা লেক না থাকলে তাদের “হৃদে মৎস্য সম্পদ নিয়ে গবেষণার কাজ” থাকবে কি-না প্রশ্ন করা হলে তিনি কণুফুলী নদী ও কাপ্তাই হৃদে দুষণ,অবৈধ দখল/স্থাপনার বিষয়টি স্বীকার করেন।
এবিষয়ে পরিবেশবাদি সাংবাদিক ও সমাজ সেবক জুঁই চাকমা বলেন, কর্ণুফুলী নদী ও কাপ্তাই হৃদে দুষণ,অবৈধ দখল/স্থাপনার উচ্ছেদ করিতে হলে এখানে বাংলাদেশ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, বিচার বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিএফডিসি, বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্তৃপক্ষ, বন বিভাগ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী উপকেন্দ্র, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙামাটি জেলা প্রশাসন ও ১০ উপজেলার প্রশাসন, রাঙামাটি জেলা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, রাঙামাটি জেলা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি.ফায়ার সার্ভিস প্রতিনিধি, জেলা ও উপজেলা জনস্বাস্থ্য, রাঙামাটি পৌরসভা, বাঘাইছড়ি পোৗরসভা, বাংলাদেশ নৌ বাহিনী, বাংলাদেশ সেনা বাহিনী, বিজিবি, নৌ পুলিশ, জেলায় অবস্থিত সকল গয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, আসনার ও ভিডিপি, পর্যাটন করপোরেশন, সকল নৌ যানের মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি, হোটেল-মোর্টেল মালিক, চেম্বার অব কর্মাস, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, জেলেদের প্রতিনিধি. জেলা অবস্থিত বাজার সমুহের কমিটির প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাঙামাটি জেলায় কর্মকান্ড রয়েছে এধরনের জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, পরিবেশবাদি সংগঠন ও জেলায় কর্মরত গণমাধ্যম কর্মীদের ইত্যাদি সংস্থার.সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে প্রতি মাসে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলে কয়েক বছরে মধ্যে কণুফুলী নদী ও কাপ্তাই হৃদে দুষণ,অবৈধ দখল/স্থাপনার উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, রাঙমাটিতে রক্ষক এখন ভক্ষকের ভুমিকা পালন করছে অথচ এসব দেখার বা তদারকি কারার কেউ নেই।
পরিবেশবাদি জুঁই চাকমা কণুফুলী নদী ও কাপ্তাই হৃদে দুষণ,অবৈধ দখল/স্থাপনার দ্রুত উচ্ছেদের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।