যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন: ট্রাম্প-বাইডেনের যত প্রতিশ্রুতি

একদিন পরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট। এরই মধ্যে নয় কোটি ভোটার আগাম ভোট দিয়ে দিয়েছে। যারা ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেবেন তারাও হয়ত মনে মনে প্রার্থী ঠিক করে ফেলেছেন।

নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বীরা নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের দলে টানেন। দেশটির প্রধান দুই দল রিপাবলিকান (ডনাল্ড ট্রাম্প) ও ডেমোক্র্যাটিক (জো বাইডেন) প্রার্থীরাও এবার নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আটটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বা নির্বাচিত হলে কী কৌশল গ্রহণ করবেন তা তুলে ধরেছেন।

দুই প্রার্থীর প্রতিশ্রুতিতে দেখা গেছে বিস্তর ফারাক। কোনও কোনও ইস্যুতে দুই প্রার্থী রয়েছেন একেবারে বিপরীত অবস্থানে। বিবিসি’র বিশ্লেষণে উঠে এসেছে সেই চিত্র:

কোভিড-১৯ মহামারী:

যুক্তরাষ্ট্রে এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে করোনাভাইরাস মহামারী।

চীনের উহান শহর থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই মহামারী নিয়ন্ত্রণে গত জানুয়ারির শেষ দিকে ‘করোনাভাইরাস টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কিন্তু ওই টাস্ক ফোর্স যে কাজের কাজ কিছুই করেনি তার প্রমাণ দেশটিতে মোট সংক্রমণ এবং মোট মৃত্যুর সংখ্যা। উভয় তালিকাতেই এক নম্বরে যুক্তরাষ্ট্র।

নিজ দেশে মহামারী নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। নির্বাচনের সময়ে এ ইস্যুতে বেশ বেকায়দায় পড়েছেন তিনি।

এবার নির্বাচনী ইশতেহারে এ ইস্যুতে তিনি বলেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি “দেশের নিরাপত্তা এবং পুনরায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক করার দিকে মনযোগ দেবেন।” তিনি কোভিড-১৯ টিকা আবিষ্কার এবং এ রোগের চিকিৎসার উপায় খুঁজে বের করতে গবেষণা কাজের গতি আরও বাড়ানোর কথাও বলেছেন।

অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী বাইডনে বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে ‘কন্টাক্ট-ট্রেসিং প্রোগ্রাম’ চালু করবেন। এছাড়ও প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে অন্তত ১০টি নমুনা পরীক্ষা সেন্টার স্থাপন করা এবং সবাইকে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার সুযোগ করে দেবেন।

তিনি দেশজুড়ে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করবেন বলেও জানিয়েছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনঃ

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আ‍সার পরপরই জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিষয়টির বাস্তবতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। এমনকী তিনি জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করে পৃথিবীকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করা ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তির’ মতো আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র এ বছরের শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই চুক্তি থেকে সরে যাবে।

এছাড়া, ট্রাম্প পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অ-নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে চান। এজন্য তিনি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে জোর দিয়েছেন।

জলবায়ু ইস্যুতে ট্রাম্পের একেবারে বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন বাইডেন। তিনি বলেছেন, ভোটে জয়ী হলে তিনি পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অংশ করবেন।

এছাড়ও বাইডেন বলেছেন, তিনি চান ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কার্বন নিঃসরণ শূন্যতে নামিয়ে আনুক। তিনি সরকারি জমিতে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য নতুন করে ইজারা দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে চান। একই সঙ্গে পরিবশের জন্য ভাল ‘গ্রিন এনার্জি’ প্রকল্পে দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার কথাও বলেছেন।

অর্থনীতি:

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগামী ১০ মাসের মধ্যে এক কোটি মানুষের জন্য নতুন কার্মসংস্থান এবং ১০ লাখ নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এছাড়া, তিনি আয়কর হ্রাসের কথা বলেছেন এবং নানা কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় উৎসাহ দিতে ‘ট্যাক্স ক্রেডিট’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এ বিষয়ে বাইডেন বলেছেন, তিনি উচ্চবিত্তদের উপর কর আরও বাড়াতে চান। যাতে বড়াতি অর্থ সরকারি নানা সেবা খাতে বিনিয়োগ করা যায়। তবে তিনি এটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন, যাদের আয় বছরে চার লাখ মার্কিন ডলারের বেশি কেবল তারাই ওই করের আওতায় পড়বেন।

তিনি প্রতি কর্মঘণ্টায় সর্বনিম্ন মজুরি বাড়ানোর (প্রতিঘণ্টায় ১৫ মার্কিন ডলার) পক্ষেও মত দিয়েছেন। বর্তমানে সর্বনিম্ন মজুরি প্রতিঘণ্টায় ৭ দশমিক ২৫ ডলার।

স্বাস্থ্যসেবা:

সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে হওয়া অ্যাফোরডেবল কেয়ার অ্যাক্ট (এসিএ) বাতিল করতে চান ট্রাম্প। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ‍সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমা খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে এ আইন করা হয়। এ আইনে যেসব মানুষ দীর্ধমেয়াদে নানা জটিল রোগে ভুগছেন, বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলো যেন তাদের সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে না পারে তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এ আইনের আরও উন্নয়ন এবং বিকল্প ব্যবস্থা চান। তবে কী ধরনের উন্নয়ন বা কী বিকল্প চান সে বিষয়ে কখনেওই বিস্তারিত কিছু বলেননি। তিনি বিদেশ থেকে কমদামী ওষুধ আমাদানি করে দেশে ওষুধের দাম কমানোর ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন।

অন্যদিকে, বাইডেন এসিএ-র সুরক্ষা এবং এ আইনের আরও বিস্তার চান।

তিনি বয়স্ক নাগরিকদের জন্য দেশে যে ‘চিকিৎসা সেবার’ (মেডিকেয়ার) ব্যবস্থা আছে সেটার আওতা আরও বাড়াতে চান। এজন্য তিনি বর্তমান বয়স ৬৫ থেকে কমিয়ে ৬০ বছর করতে চান। যাতে আরও বেশি মানুষ এই সেবা পায়।

বৈদেশিক নীতি:

ট্রাম্প আবারও বিদেশে দায়িত্বরত মার্কিন সেনার সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গত নির্বাচনেও তিনি একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং সে অনুযায়ী কাজও করেছেন। তবে তিনি দেশে সামরিকখাতে ব্যয় বাড়িয়েছেন এবং তা অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছে।

শুল্কারোপ অব্যাহত রেখে ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক জোটগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানো থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিরত হবে না বলে ট্রাম্প আভাস দিয়েছেন।

বাইডেন বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবেন।

চীনের বিষয়ে তিনি বলেছেন, তিনি চীনের উপর একতরফা শুল্কারোপ করবেন না। তবে আন্তর্জাতিক জোটের মাধ্যমে তিনি চীনকে এমনভাবে ‘জবাবদিহিতায়’ বাধ্য করবেন যেন চীন তা ‘এড়িয়ে যেতে না পারে’।

বর্ণবাদ:

যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীতে বর্ণবিদ্বেষ একটি ‘পদ্ধতিগত’ সমস্যা বলে মনে করেন না ট্রাম্প। অন্যদিকে, বাইডেন পুলিশ বাহিনীর ভেতর বর্ণবিদ্বেষকে একটি ‘পদ্ধতিগত সমস্যা’ মনে করেন।

বাইডেন বলেছেন, তিনি এমন একটি নীতি গ্রহণ করবেন যাতে বর্ণবিদ্বেষের ঘটনাগুলোকে আইনের আওতায় আনা যায়। বর্ণবাদী বিভাজন কমিয়ে আনতেই এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

৭৭ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান বাইডেন অনেক কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান আইনপ্রণেতা এবং কৃষ্নাঙ্গ ভোটারদের সমর্থনের ভিত্তিতে ডেমোক্র্যাটিক দলের মনোনয়ন পেয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার রানিংমেট থাকাসহ এবারের নির্বাচনে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসাবে কমলা হ্যারিসকে রানিংমেট হিসাবে নিয়ে বাইডেন এরই মধ্যে আমেরিকার রাজনীতিতে একটি ভিন্ন অবস্থান তৈরি করেছেন।

পুলিশে তহবিল না দেওয়ার আহ্বান বাইডেন প্রত্যাখ্যান করেছেন। বরং সঠিক মান রক্ষার জন্য তিনি পুলিশের বাড়তি তহবিল দেওয়ার পক্ষে।

আগ্নেয়াস্ত্র:

বাইডেন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি গণহামলায় ব্যবহার করা যায় এমন আগ্নেয়াস্ত্র (অ্যাসল্ট উইপন) বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়ও বন্দুক বিক্রির আগে ক্রেতার অতীত খুব ভালোভাবে পরীক্ষা এবং একজন কয়টি বন্দুক কিনতে এবং এক সময়ে বহন করতে পারবেন সেটার সীমা বেঁধে দিতে চান।

তিনি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার কাজও সহজ করতে চান। কিভাবে বন্দুক হামলা কমিয়ে আনা যায় তা নিয়ে গবেষণা কাজেও তহবিল বাড়াতে চান বাইডেন।

ওদিকে, আমেরিকানদের নিজেদের সুরক্ষায় আগ্নেয়াস্ত্র রাখার সাংবিধানিক অধিকারের পক্ষে ট্রাম্প বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

তবে ২০১৯ সালে বেপরোয়া বন্দুক হামলার কয়েকটি ঘটনার পর বাইডেনের মতো ট্রাম্পও বন্দুক ক্রেতাদের অতীত পরীক্ষা করে দেখার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনার কিছুই বাস্তাবায়ন হয়নি এবং এ সংক্রান্ত কোনও আইনও সামনে আসেনি।

সুপ্রিম কোর্ট:

ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতির শূন্যস্থান পূরণ করাকে নিজের সাংবিধানিক অধিকার বলে বর্ণনা করেছেন এবং এরই মধ্যে শুন্য আসনে রক্ষণশীল নতুন বিচারপিতি এমি কনি ব্যারেটকে নিয়োগ করেছেন।

অন্যদিকে, বাইডেন মনে করেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতির শূন্য আসনে নিয়োগ হওয়া উচিত ছিল নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা নেওয়ার পর এবং তিনি এমনটাই চেয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে নারীর গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে শিগগিরই আদেশ জারি করতে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট।

বাইডেন বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে সুপ্রিম কোর্ট যদি গর্ভপাতের অধিকারের বিরুদ্ধে আদেশ দেয় তবে তা আটকে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার সুনিশ্চিত করতে তিনি আইন পাস করবেন।