জগতে মাতৃশক্তি একটি বিশেষ ফ্যাক্টর। পুরুষ তান্ত্রিক সমাজে এ শক্তিকে হীন বা দুর্বল অবস্থায় রাখা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে অবমাননাও করা হয়। অশুভ শক্তি সহায়ে তাকে লাঞ্চিতও করা হয়। এর বিপরীতে উন্নত ও সভ্য দেশে আবার মাতৃশক্তির সমাদর, সম্মাননা অধিক। সৃষ্টিলগ্ন থেকে মাতৃশক্তি ও পুরুষশক্তির সমন্বিত ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। একটি ব্যতীত অন্যটি যে অন্তঃসার শূন্য তা বারবার প্রমাণিতও হয়েছে। সমস্ত বিশ্বে অশুভ শক্তির আত্মম্ভরিতার জবাব দানের জন্যই শিল্প কর্মের মাধ্যমে নারী শক্তির মহাভাবের প্রকাশ হলো, এ শারদীয় বা বাসন্তীয় দুর্গাপূজা। শরৎকাল প্রকৃতির অনুপম, মনোরম এবং মনোহর রুপ প্রকাশের ঋতু। এ ঋতুর যে উপাদানগুলো মানব মনকে পুলকিত করে- তাহলো, শরতের সুশীতল নীলিমাযুক্ত সুনীল আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের ভেলা। বৃষ্টিøাত স্বচ্ছ রুপ সজ্জিত বৃক্ষরাজির সবুজ আচ্ছাদন। নদীর চড়ে ঝিকিমিকি বালি কোলের মনোমুগ্ধকর ধুসর রঙের কাশফুল। এ সময়ের প্রকৃতি যেন বিশেষ মায়াবীরুপী। এমন একটি øিগ্ধ পরিবেশে অকাল আবাহনে মাতৃরুপনিী মহামায়ি দুর্গা শুভ শক্তির মহিমা প্রদর্শনে মর্তে শুভাগমন করেন। ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের বোধনে এ মাতৃশক্তির মহিমা প্রকাশ। অসুর নিধনে সহায়তাকামী শ্রীরামচন্দ্র এ শুভ শক্তি সহায়ে বিজয়ীও হয়েছিলেন।
দুর্গা পূজায় শিল্প কর্মের মাধ্যমে প্রতিমার যে কাঠামো তৈরী করা হয়, তাতে আমরা দেখতে পাই যশ, শ্রী, শৌর্য, বীর্য, ঐশ্বর্য, উদয়, জ্ঞান এগুলোর পূর্ণ অবয়বের সুদৃশ্য ও সমাহার। প্রতিমায় অধিষ্ঠিতা লক্ষ্মী দেবী ধনদাত্রী, সরস্বতী দেবী বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী, কার্তিক প্রতিরক্ষায়, গণেশ সিদ্ধিদাতা, সিংহ পশু কূলের শ্রেষ্ঠ শক্তির স্বরুপ, হংস শান্তি, ময়ূর গতির প্রতীক। এ সকলের সম্মিলিত শক্তি পূঞ্জীভুতা মা দুর্গা। শুভ শক্তি সহায়ে তিনি অশুভ শক্তি বিনাশে অগ্রনায়িকা। তিনি পিছু হটার পাত্রী নন। আজ সমস্ত বিশ্বেও দেখা যায় নারী শক্তির জয়জয়কার। দেশ নেত্রী থেকে মহাকাশে উড়াল পর্যন্ত। মুষিক থেকে পশুরাজ সিংহ সমন্বিতে মায়ের সংসার।
এ পূজার একটি বিশেষ দিক হলো, এতে লক্ষ লক্ষ গরীব-দুঃখী মানুষ আর্থিক সমৃদ্ধি লাভ করে। ফুল বিক্রেতা থেকে রং, খড়কুটো, খাদ্য, বস্ত্র, স্বর্ণকার, কর্মকার, পুরোহিত সকলে উপকৃত হয়। আর্থিক সমৃদ্ধিতে আসে প্রত্যেকের পরিবারে অনাবিল শান্তি।
আমাদের এ বঙ্গভূমি এমনিতেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ পূজায় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সকলে আনন্দ øাত হয়। শিল্পকর্ম, সৃজনশীলতা মানসিক পরিতৃপ্তির সহায়ক, তাই এ পূজার যে আনন্দ তা বিশেষ কোন সম্প্রদায়, গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। মাতৃশক্তির মহিমায় সকলেই অনুরণিত হয়।
আমাদের অতি প্রাচীনতম শুদ্ধ প্রাণ মুনি-ঋষিগণের শিল্প মনের কঠোর তপস্যায় লব্ধ মায়ের এ মনোহর রুপ। বিশেষ তাৎপর্যে মন্ডিত এ পূজার বিধি বিধানও।
নব পত্রিকায় পূজিত মায়ের নয়টি ভাবাবহের আবহ একটি বিশেষ দিক। জগতে বৃক্ষের মতো দাতা খুবই কম। কদলী, কচু, দাড়িম্ব, ধান্য, হরিদ্রা সম্বলিতে মায়ের আবাহন লক্ষিত হয়। øিগ্ধতা, সজীবতা, প্রাণোচ্ছ্বল আবহেই মায়ের মর্তে পদচারণ। মর্তে সুখ দান করতেই মায়ের শুভাগমন। দুর্গমকে লঙ্গিতে, অশুভ নাশিতে বারবার মায়ের এ আগমন।
ভগবান রামচন্দ্র রাবণ বধে সাহায্য নিয়েছিলেন মহাশক্তিময়ী মায়ের। মহিষাসুর, রম্ভাসুর নামক অসুরদের অত্যাচারে অতিষ্ট দেবতাগণও মায়ের সাহায্য নিয়েছিলেন। যুগে যুগেই অসুর ছিল। আর তা শুভ শক্তির নিকট পরাস্ত হয়েছে।
বীভৎস, কদাচার, অশুদ্ধ মনেও অসুর বাস করে। এ অসুরের কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহতা চির অতৃপ্ত। এগুলোর প্ররোচনা থেকে অনেকেই রেহাই পায়না। সেজনই এ শক্তিময়ী জগজ্জননী মহামায়ী দুর্গার নিকট শুদ্ধ মনে প্রার্থনা জানাতে হয়, যাতে এ রিপুগুলোর তাড়নার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আমাদের শক্তি জন্মে।
যুদ্ধ নিরন্তর। শুভ অশুভয়, ভাল মন্দে, সুর অসুরে। আমাদের প্রার্থনা একটিই যেন সমস্ত বিশ্ববাসী একটি পারিবারিক বন্ধনে, সুখে শান্তিতে, সুন্দর সৌহার্দ্রে বসবাস করে আনন্দময় পৃথিবী গড়ি। মায়ের কাছে প্রত্যাশা বারবার এসে আমাদের আনন্দধারা অব্যাহত রাখেন। তিনি দশভুজা। দশ দিক সামলিয়ে সুখী-সুন্দরে পূর্ণ করেন এ বিশ্ব সংসার। জয় মা।