পাবনায় মুক্তিযুদ্ধকালীন এফ.এফ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু

। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে ভাসানীপন্থী ছাত্র ইউনিয়নে ( মেনন) জড়িত থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে ২৮ ও ২৯ মার্চ পাবনায় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত নগরবাড়ী ঘাটে অবস্থান করে প্রতিরোধ যুদ্ধ করেন। এরপর ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে ৭ নং সেক্টরের অধীনে যুক্ত হন। সীমান্ত এলাকায় একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহন শেষে পাবনার এফ.এফ কমান্ডার নিযুক্ত হন। পাবনায় ঐতিহাসিক শানির দিয়াড় যুদ্ধ, সুজানগর থানা আক্রমণ সহ অনেকগুলি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসীকতার সাথে যুদ্ধ করে বীরত্ব গাঁথা ইতিহাস রচনা করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু পাবনার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। বাবা এ,কে,এম মনসুর আলী ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন। দাদা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। পিতা ও পিতামহের আদি ভিটা সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের মাজপাড়া গ্রাম। পরবর্তীতে পাবনা শহরের থানা পাড়ায় বসবাস। তাঁরা ৫ ভাই এবং ৫ বোন। ভাইদের মধ্যে চতুর্থ হলেন, মকবুল হোসেন সন্টু। বড় ভাই ফজলুল করিম বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের ভায়রা। মেজ ভাই হাসিবুল হাসান হাবুল, তৃতীয় ভাই তোসাদ্দেক হোসেন বেনু এবং ছোট ভাই মোশারফ হোসেন বাবলু। তাঁরা পাবনা শহরে অত্যন্ত পরিচিত।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু ১৯৪৩ সালের ৬ জুন বাবার কর্মস্থল জামালপুর জেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম মোছাঃ হেলেন রশীদা। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে আইএ ভর্তি হন। সেখানে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সাথে জড়িত হন। ১৯৭১ সালে বিএ পরীক্ষার আগে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান সৈন্যরা পাবনা শহরে অবস্থান গ্রহণ করেন। ঐদিনই পাকিস্তানী সৈন্যরা শহর থেকে আওয়ামী লীগের নব-নির্বাচিত এমপিএ এডভোকেট আমিন উদ্দিন, ন্যাপের জেলা সভাপতি ডাঃ অমলেন্দু দাক্ষী, রাধানগর তৃপ্তি নিলয় হোটেলের মালিক ও মটর ব্যবসায়ী সাঈদ উদ্দিন তালুকদার সহ অসংখ্য ব্যক্তিকে আটক করে। ২৭ মার্চ গভীর রাত থেকে পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনতা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। পরেরদিন ২৮ মার্চ দুপুরে আগে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবস্থানরত সমস্ত সৈন্যকে হত্যা করা হয়। একই দিন পাবনার লস্করপুরে (বর্তমান বাসটার্মিনাল) অবস্থানরত সৈন্যদের সেখানে হত্যা করা হয়। সেখানে প্রথম শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম বুলবুল ( যার নামে শহীদ বুলবুল কলেজ) সহ ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা। পরের দিন পাবনা শিল্প এলাকায় ( বিসিক) অবস্থানরত পাকিস্তান সৈন্যরা সেখান থেকে পলায়ন করলে প্রায় ১৭ টি স্থানে খন্ড খন্ড যুদ্ধে সমস্ত সৈন্যরা নিহত হয়। ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা শহর মুক্ত ছিল। পাকিস্তানী সৈন্যরা নগরবাড়ী ঘাট হয়ে দ্বিতীয় দফায় পাবনা প্রবেশের চেষ্টা করলে সেখানেও প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়।

পাবনায় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। উক্ত যুদ্ধে তাঁর মেজ ভাই হাসিবুল হাসান হাবুল অস্ত্র হাতে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১০ এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা দ্বিতীয় দফায় পাবনা প্রবেশ করলে মকবুল হোসেন সন্টু এবং তার পরিবার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের মাজপাড়া গ্রামে আশ্রয় নেয়। এপ্রিল মাসে পাকিস্তানীরা সৈন্য এবং তাদের দোসররা ব্যাপক হারে গনহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে মকবুল হোসেন সন্টু তাঁর আপন ছোট ভাই মোশারফ হোসেন বাবলু এবং আপন চাচাতো ভাই তালেবুল ইসলাম রাজুকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। কয়েকদিন ধরে হেঁটে তারা কুষ্টিয়া হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন। পথিমধ্যে পাবনা-কুষ্টিয়ার মধ্যবর্তী ডিগ্রীচরে ডাকাতদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারান। জিনিসপত্র হারালেও তাদের জীবন ফিরে পান। ডাকাতরা তাদের হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। ডাকাতদের কাছে জীবন ফেরত পাওয়া আর ছোট ভাইয়ের কাছে লুকিয়ে রাখা এক’শ টাকা থাকায় তাদের মধ্যে আবার শক্তি সঞ্চয় হয়। এরপর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। প্রথম দফায় ডাকাতদের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে পারলেও দ্বিতীয় দফায় জীবন বাঁচানো ছিল আরো অস্বাভাবিক।

ভারতে প্রবেশ করার পর শরনার্থীদের দুরবস্থা দেখে তাঁরা কলকাতা চলে যান। সেখান থেকে তার দুই ভাইকে আসামে পাঠান। আসামে তাদের এক চাচা বসবাস করেন। দুই ভাইকে আসামে পাঠিয়ে মকবুল হোসেন সন্টু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য পাবনার জন্য নির্ধারিত ট্রানজিট ক্যাম্প নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙ্গা আসেন। সেখানে আসার পর প্রথম দেখা হয় পাবনা জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আব্দুস সাত্তার লালু’র সাথে। তিনি মকবুল হোসেন সন্টুকে দেখে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যাবার কথা বলেন। তিনি বলেন ক্যাম্পে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ তাকে দেখলে নক্সাল হিসেবে তার নির্ঘাত মৃত্যু হবে। সেখানে এমন অভিযোগে অনেককে হত্যা করা হয়েছে। যাইহোক সেখান থেকে ছাত্রলীগ নেতা আব্দুস সাত্তার লালু কৌশলে পিছন দিক দিয়ে মকবুল হোসেন সন্টুকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন। পরে তাঁর কথা জানাজানি হলে গোটা ক্যাম্প তন্ন তন্ন করে খোঁজ করা হয়েছিল। সেদিন তাঁকে পাওয়া গেলে নির্ঘাত মৃত্যু হতো।

এরপর সেখান থেকে পালিয়ে করিমপুর এলাকায় যান। সেখানে ঈশ্বরদীর এক পরিচতজনের সহযোগিতায় করিমপুর ট্রানজিট ক্যাম্পে আশ্রয় পান। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর মেহেরপুর মহকুমার তৎকালীন এসডিও ( বর্তমান জ্বালানী ও খনিজ উপদেষ্টা) তৌফিক এলাহি চৌধুরী আসেন মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করতে। সবাইকে দাঁড় করিয়ে উনি জিজ্ঞাসা করেন, এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বা ডিগ্রি পাশ কেউ আছেন কিনা? সেখানে এমন কেউ না থাকায় প্রায় শতাধিক ছেলেকে বাছাই করা হয়। এরমধ্যে মকবুল হোসেন সন্টু ছিল বি,এ পরীক্ষার্থী বাকীরা ম্যাট্রিক বা আরো নীচের। প্রথমেই মকবুল হোসেন সন্টুকে পছন্দ করেন। তিনি ছিলেন দলের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিত এবং সুদর্শন। এরপর বাছাইকৃতদের করিমপুর থেকে কলকাতা সংলগ্ন কল্যানীতে আনা হয়। সেখান থেকে ব্যারাকপুর আনা হয়। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রাকে তুলে বিহার প্রদেশের চাকুলিয়ায় নেওয়া হয়। পরেরদিন থেকে শুরু হয় উচ্চতর প্রশিক্ষণ। সেখানে একমাস ধরে ট্রেনিং প্রদানের পর তাঁদের ৭ নং সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টারে আনা হয়।

মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলায় ৭ নং সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন গিয়াসের অধীনে রাজশাহী এবং চাঁপাই নবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় তাঁরা অনেক যুদ্ধে অংশ নেন। এছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ছোট বড় অনেকগুলি অপারেশন করেন। উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল, রাজশাহী-চাঁপাই প্রধান সড়কে শীতলাই ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়া, চাঁপাই নবাবগঞ্জের অভায়া ব্রীজ ও রাজশাহীর কাটাখালি ব্রীজ অপারেশন করেন। এছাড়া নভেম্বর মাসে প্রথম সপ্তাহে সারদা পুলিশ একাডেমি আক্রমণ করা হয়। এরপর নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার সিদ্ধান্ত নেন, পাবনার জেলার অভ্যন্তরে এফ.এফ বাহিনীর একটি বড় দলকে পাঠানো হবে। উল্লেখ্য তখন পর্যন্ত পাবনায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত মুজিববাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা দায়িত্বে ছিলেন।

নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন এর নির্দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টুকে কমান্ডার নিযুক্ত করে প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে পাবনায় প্রবেশ করার নির্দেশ দেন। এরপর তাঁরা পদ্মা নদী পার হয়ে ঈশ্বরদী এবং পাবনার চরাঞ্চলে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা পাবনা প্রবেশের পরেরদিন ২৭ নভেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে সংঘটিত শানির দিয়াড় যুদ্ধে অংশ নেন। শানির দিয়াড় যুদ্ধ শেষে তিনি এবং তাঁর দল সুজানগর উপজেলা এলাকায় অবস্থান নেন। তখন সুজানগর উপজেলায় মুজিববাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ ইকবাল এবং উপপ্রধান জহুরুল ইসলাম বিশু সহ বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন। তাঁরা সম্মিলিত ভাবে সুজানগর এবং পাবনা সদর উপজেলার একটি বড় অঞ্চল জুড়ে তৎপরতা চালাতে থাকে। ১১ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুজানগর যুদ্ধ শেষ করে তারা পাবনা অভিমুখে রওয়ানা হন। ১৪ ডিসেম্বর সুজানগর থানা মুক্ত করার পর ১৫ ডিসেম্বর পাবনা মুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন হয়। স্বাধীনতার পরে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পনের পুর্ব পর্যন্ত জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন পরিচালনা করতেন। সেই হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু পাবনা সদর থানার অফিসার ইন চার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অানুষ্ঠানিক অস্ত্র সমর্পন করে তিনি সংসার জীবনে মনোনিবেশ করেন।

স্বাধীনতার পরে উনি ঢাকা বসবাস শুরু করেন। প্রথমে ব্যবসা বানিজ্য শুরু করলেও পরবর্তীতে বিদেশ চলে যান। সংসার জীবনে পাবনার শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম সারোয়ার খান সাধন এর খালা শাহানা পারভিনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু’র ২ ছেলে ২ মেয়ে। ছেলে তৌফিক হোসেন রনি এবং তৌহিদ হোসেন বনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু নব্বইয়ের দশকে রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৮৬ এবং ৮৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে পাবনা -২ ( সুজানগর -বেড়া) থেকে দুইবার এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে পাবনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনোনীত হন। তাঁর জীবনকালে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানী, সুইজারল্যান্ড, ইরান, মিশর, ইরাক, কুয়েত, জর্ডান, লেবালন, ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেছেন। এছাড়া তিনি সৌদি আরবে গমন করে হজ্জ পালন করেছেন। এই ক্ষণজন্মা বীর মুক্তিযোদ্ধা স্ত্রী, পুত্র ও পরিজনসহ পাবনা শহরের থানা পাড়ায় নিজ বাসভবনে বসবাস করছেন।

পরিশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু’র জন্য প্রত্যাশা মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি সরূপ তাঁর জীবদ্দশায় পাবনার কোন স্থাপনা বা সড়ক নামকরণ করে এই বীরের স্মৃতি সংরক্ষণ করা হোক।
( সমাপ্ত)

লেখক পরিচিতি –

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
২৫ অক্টোবর ২০২০