আলাউদ্দিন আহমেদ
এ কেমন রাজনৈতিক শিষ্টাচার বুঝলামনা। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রকাশ্য টকশোতে কিভাবে সিনিয়র একজন রাজনীতিককে উদ্দেশ্য করে থুতু নিক্ষেপ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন-? এই দৃশ্যটি বিস্মিত হয়ে বহু দর্শক-স্রোতা প্রত্যক্ষ করলেন চ্যানেল আই এর লাইভ টকশোতে।
এই অস্বাভাবিক ও অশালীন কাজটি করেছেন পাবনা-৪ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এক সময়ের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান হাবিব। গত ২৬শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এই আসনের উপনির্বাচনের দিন চ্যানেল আই দুইজন প্রার্থীর বক্তব্য সরাসরি ধারন ও প্রচার করে। এখানেই তিনি নির্বাচনের নানান অনিয়মের কথা তুলে ধরে এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে আওয়ামীলীগ নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব নুরুজ্জামান বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন, ‘এক সময় আমি এই মানুষটিকে নেতা মানতাম তা ভাবলে এখন ঘৃনা লাগে’। এই পর্যায়ে হাবিব তাকে উদ্দেশ্য করে থুতু নিক্ষেপ করেন।
হাবিবুর রহমান হাবিব আপনার সৌভাগ্য ছিল আওয়ামীলীগ প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার স্নেহ লাভ করেছিলেন। তাঁর আশির্বাদে আপনি ছাত্রলীগের মত একটি বিরাট ও ঐতিহ্যবাহি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় এইচএম এরশাদের শাসনাধীন স্বৈরাচারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার পুরোভাগে আপনি ছাত্রদলের আমান উল্লাহ আমান সহ আরো কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দের আসার সুযোগ হয়েছিল। সংগঠন ও আন্দোলন আপনাকে ওই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। আপনার একক কোন বিশেষ ভূমিকা (পযধৎরংসধঃরপ) ছিলনা। এই আন্দোলনের পিছনে হাজারো ছাত্র-জনতার সরাসরি অবদান ছিল। যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন এই সংগ্রামে তাঁরাও চিরস্মরণীয়। সুতরাং এটাকে এককভাবে নিজেকে হিরো বানিয়ে ‘বিশ্বনেতা’ ভাবার কোন কারন নেই। আপনার বিভিন্ন কথাবার্তায় প্রায়ই বলেন সারাবিশ্বের মানুষ আপনাকে চেনে। চিনতেই পারে, খন্দকার মুশতাকের নামও কোটি কোটি মানুষ জানে, মীরজাফরের নামও ইতিহাসে লেখা রয়েছে। তাই একটি আন্দোলনের হিরো পরবর্তী যেকোন ভূমিকায় জিরো হতে রাজনীতিতে সময় লাগেনা। আপনি এখন কোন পর্যায়ে সেটা নিজেই আত্মমূল্যায়ন করুন, নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন।
একটি এলাকায় নুরুজ্জামান বিশ্বাস এর মত নেতা অনেক তৈরি হয়না। তিনি মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে দেশপ্রেম আর সাহসিকতার প্রমান দিয়েছেন। ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে বর্তমানের এমপি হওয়া পর্যন্ত যে ধারাবাহিক ‘রাজনীতির-সড়ক’ তাতে খানাখন্দও কম ছিলনা। অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জনগনের ভালবাসা অর্জন করা ছিল নুরুজ্জামান বিশ্বাসের অন্যতম সফলতা। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি/ গভর্নিং বডির সদস্য, তিনবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করে তিনি কোনটিতেই পরাজিত হননি। সুতরাং তাঁর মত একজন সফল রাজনীতিকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে বিজয় অর্জন করার মত যোগ্যতার গলা আপনিই অনেক আগে কেটে ফেলেছেন। নব্বই এর আন্দোলন আপনাকে যে সফলতা এনে দিয়েছিল তা আপনিই অধৈর্য, শুধুমাত্র তড়িঘড়ি এমপি হওয়ার ঝোঁক এবং সেই কারনে দল বদল আপনার রাজনৈতিক জীবন থেকে ইতোমধ্যে উনত্রিশটি বছর (১৯৯১ থেকে ২০২০) কেড়ে নিয়েছে। এখনো কোন রকম সফলতার মুখ দেখেননি। নিরিবিলিতে বসে নিজেকে নিয়ে ভাবুন, তাতে যে চিত্র দেখবেন তা থেকেই নতুন করে শিক্ষা নিতে হবে আপনাকে। একবার ভুল মানুষ মেনে নেয়; কিন্তু বারবার ভুল কেউ মানেনা।
আপনি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হিসেবে দলের উচ্চাসনে রয়েছেন। কিন্তু যেখানে আপনি নির্বাচন করেন সেই জায়গার শতশত দলীয় কর্মী কি আপনাকে আজো মেনে নিয়েছে-? এবারের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যস্থতায় সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম সরদারের সাথে ‘কেয়ামত পর্যন্ত ঐক্য’ তৈরির যে ঘোষনা দেয়া হয়েছে তা কি বাস্তবে দৃশ্যমান হয়েছে-! কেউ তা মনে করেনা। তাহলে কোথায় গেল ঐক্যের কর্মী বাহিনী। ঈশ্বরদী পৌরসভার পশ্চিমটেংরী এলাকায় সব সময় বিএনপির একটি প্রভাব দৃশ্যমান থাকে। অনেক কর্মীর অবস্থান ওই এলাকায় রয়েছে। তাহলে ভোট কেন্দ্রে কেন এজেন্ট ছিলনা। আসলে বিএনপির একটি বড় অংশের কর্মীরা আপনার সাথে অতীতেও ছিলনা, এখনো নেই যা নির্বাচনে প্রমান হয়েছে। আপনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বারোটা আপনিই বাজিয়েছেন। এরজন্য অন্য কাউকে দোষারোপ করে কোন লাভ নেই।
২৬ শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন সম্পর্কে আপনি সমালোচনা করতেই পারেন, এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেটা করতে যেয়ে অন্য প্রার্থী যিনি এক সময় আপনার নেতা ছিলেন, যিনি আপনাকে শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন আপনার ভবিষ্যত ভাল’র জন্য তাঁর উদ্দেশ্যে থুতু নিক্ষেপ করার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা সৃষ্টি করে আপনার যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও শেষ করে ফেলেছেন। যাই ভাবুননা কেন জনাব হাবিবুর রহমান হাবিব আপনাকে আবার শুন্য থেকে শুরু করতে হবে, এছাড়া কোন উপায় নেই।
এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চ্যানেলে সাক্ষাতকারে বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব নুরুজ্জামান বিশ্বাস আপনার সম্পর্কে যথাযথ ভালবাসা নিয়ে বলেছিলেন, ‘হাবিব আমার ছোট ভাইয়ের মত। সে আওয়ামীলীগে থাকলে আজ মনোনয়ন সেই পেতো’। টকশোতে আপনার ওই আচরণ আর নুরুজ্জামান বিশ্বাসের এই বক্তব্যের পার্থক্য খুঁজুন। তাতে কিছু দেখতে পাচ্ছেন কি? আমার বিশ্বাস সঠিকটা দেখলে ‘বিবেকের-অন্ধকার’ ছাড়া কিছু দেখবেননা। অন্যদিকে যে চিত্র আপনি দেখবেন তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার শুন্য থেকে শুরু করা ছাড়া কোন উপায় নেই। অনেক সময় হারিয়ে ফেলেছেন।
১৯৯১ সালে আওয়ামীলীগ আপনাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু বিএনপির সিরাজুল ইসলাম সরদারের কাছে আপনি পরাজিত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে আবার মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দিলেন (এই বছর ১৫ই ফেব্রুয়ারি আরেকটি এক তরফা নির্বাচনে আপনি ছিলেন, যদিও নির্বাচনটি টেকেনি)। সেখানেও মনোনয়ন পেলেননা, দাঁড়ালেন টেলিভিশন মার্কা নিয়ে স্বতন্ত্রে। পরাজিত হলেন। ২০০১ সালে বিএনপি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে দল থেকে বিদ্রোহ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলেন কুড়াল প্রতীক নিয়ে এবং যথারীতি পরাজিত হলেন। বিএনপি প্রার্থী সিরাজ সরদারও পরাজিত হন। এই অপরাধে আপনাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল। যদিও এসব বহিস্কার চিরস্থায়ী হয়না। হলে সম্ভবত আপনার রাজনৈতিক জীবনটা হয়ত ভাল থাকতো, ফিরতে পারতেন নিজগৃহে। এরপর আবার ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ও সদ্য অনুষ্ঠিত ২৬ সেপ্টেম্বর’২০সালের উপনির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে যথারীতি পরাজিত হলেন। আপনি এভাবে পাঁচবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে একবারও বিজয়ের মুখ দেখেননি।
বিএনপিতে ৯৬ থেকে শুরু করে ২০২০ দীর্ঘ চব্বিশ বছর চলে গেছে। আবার সংসদ নির্বাচন হবে তিন বছর পর। অর্থাৎ সাতাশ বছর হারিয়ে যাবে। এরপর আর কি থাকে? বিষয়টি আপনিই ভাবুন।
আসলে নব্বইয়ের আন্দোলন থেকে যে রাজনৈতিক অর্জন আপনি করেছিলেন তা পরক্ষনেই আপনার আত্মঅহমিকা. চেয়ারের প্রতি অতি মোহ ধাক্কা দিতে শুরু করে। সেই ধাক্কা টকশোর অশালীন আচরণ পর্যন্ত নিয়ে এসে জনগনের ধিক্কারে পরিনত করেছে।
রাজনীতির ইতিহাস বলে; ‘একটা বড় ধরনের ভুলের জন্য মানুষের সারা জীবনের সঞ্চিত ‘শুদ্ধ’ কাজ গুলিও ভুল হয়ে যায়’।
আমি একজন সংবাদকর্মী হিসেবে জানি, আপনি আমার লেখাটি পছন্দ করবেননা। এমনও হতে পারে যে অভ্যাসবশত: হয়ত আমার উদ্দেশ্যেও থুতু নিক্ষেপ করতে পারেন। উচিত কথা লিখতে গেলে অনেকেই বিরাগভাজন হন, আমাদের পেশাগত চরিত্রই এমন। এতে আমরা অভ্যস্ত। আমাদের আশা এলাকার পরিবেশটা যেন ভাল থাকে। আর এই ভাল থাকার জন্য বড় দলগুলোর নেতাদের আচরণগত বিচ্যুতি যেন না ঘটে। তাহলে সাধারন মানুষ হতাশ হয়ে পড়বে যা একটি জনপদের জন্য সুফল বয়ে আনবেনা।
তাই আসুন আমরা ঘৃনা অথবা অন্যকিছু নিক্ষেপ করার আগে ভালবাসার ভাষায় কথা বলি, ফুল দিয়ে বরণ করার পরিবেশ তৈরি করি। এতে অন্তত: নতুন প্রজন্ম কিছু রাজনৈতিক শিষ্টাচার শিখবে, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শিখবে। এসব থেকে যে পরিবেশ তৈরি হবে তার সুফল তো আপনারা রাজনৈতিক নেতারাই ভোগ করবেন।
শেষে বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি ঃ
‘আপনি আপনা চেয়ে বড়ো যদি হবে,
নিজেকে নিজের কাছে নত করো তবে’।
( লেখক: সিনিয়র সংবাদকর্মী. সাবেক ছাত্রনেতা ও কলাম লেখক। সাবেক সভাপতি-ঈশ^রদী প্রেসক্লাব)।