আজ পাবনা-৪ আসনের উপনির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বি নৌকা-ধানের শীষ-লাঙ্গল

ঈশ্বরদী (পাবনা) সংবাদদাতাঃ
আজ শনিবার পাবনা-৪ আসনের উপনির্বাচন। নির্বাচনে ৩ জন প্রার্থী থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বি নৌকা-ধানের শীষ-লাঙ্গল। নির্বাচনকে ঘিরে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহন করেছে নির্বাচন কমিশন। ১৮ জন নির্বাহী ও ২ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ৮ প্লাটুন বিজিবি, র‌্যাব ও পুরিশের স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে রয়েছে। পুলিশের পক্ষ হতে পাঁচস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এবারেই প্রথম ভোটের দিন সকাল ৮টার মধ্যে ব্যালট পেপার ভোট কেন্দ্রে পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহন করেছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ছাড়া শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত প্রতিদ্ব›িদ্ব প্রার্থীদের মধ্যে কোন সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। তবে শেষ মুহুর্তে দুই দলই অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটমাট করে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচারণা চালিয়েছে।
ঈশ^রদীর ৮৪ এবং আটঘোরিয়ার ৪৫টি মোট ১২৯টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহন হবে। মোট ৩ লাখ ৮১ হাজার ১১২ জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। জেলা রিটার্নিং অফিসার আব্দুল লতিফ শেখ জানান, নির্বাচনে সহিংসতা ও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহন করেছে নির্বাচন কমিশন। ২০ জন ম্যাজিস্ট্রেট, ৮ প্লাটুন বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে থাকছে। শুক্রবার রাত ১২টার পর অন্য এলাকার মানুষ নির্বাচনী এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না। এজন্য চেকপোষ্ট বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাইওয়ে ছাড়া অন্যান্য রাস্তায় সকল যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ রয়েছে।
ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফিরোজ কবীর নির্বাচনে পুলিশের পক্ষ হতে শতভাগ নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। ভোট কেন্দ্রে সশস্ত্র পুলিশ ও আনসার, ৫টি কেন্দ্র ঘিরে মোবাইল ফোর্স, ইউনিয়ন ভিত্তিক তদারকির জন্য স্ট্রাইকিং ফোর্স, সার্বিক তদারকির জন্য ৪ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে চারটি টিম এবং পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একটি টিম মাঠে থাকছে। আটঘোরিয়াতেও একইভাবে পুলিশী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।  
 গত ২ এপ্রিল এই আসনের পর পর পাঁচবারের এমপি সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হওয়ায় উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের ২৮ জন মনোনয়ন প্রত্যাশি থাকলেও তিন বারের নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান বিশ্বাসকে মনোনয়ন দেয়া হয়। মনোনয়নের আগে যারা মাঠ কাঁপিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ প্রচারণায় না থাকায় নূরুজ্জামান বিশ্বাস এদের ‘শীতের পাখি’ বলে মন্তব্য করেছেন। এরপরও আওয়ামী লীগ সাংগাঠনিক অবস্থা সুদৃঢ় করে মনোনয়ন প্রত্যাশিসহ নেতা-কর্মীরা প্রতিদিনই একাধিক উঠোন বৈঠক ও ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা নূরুজ্জামান বিশ্বাসের নৌকা বিজয়ের জন্য ঝাপিয়ে পড়েন। তবে এবারে শুরু থেকেই পাবনা জেলার আওয়ামী লীগ ও অংগ সংগঠনের নেতারাও প্রচারণায় নেমে নৌকায় ভোট চেয়েছেন। নৌকার পোষ্টারে ঈশ্বরদী ও আটঘোরিয়া ছেঁয়ে গেছে। ১৪ দলীয় জোট ও বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনগুলোও নৌকা বিজয়ী করার জন্য মাঠে ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পে ওয়ার্ড কমিটি, ভোট কেন্দ্র কমিটিসহ মিডিয়া সেল গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। প্রচারণার শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন এলাকায় অবস্থান করে নির্বাচনী কার্যক্রম দেখভাল করছেন। এছাড়াও কেন্দ্রীয় সভাপতি মন্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান, নির্বাহী কমিটির সদস্য কবিতা খানম, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ, জাতীয় শ্রমিক লীগ সভাপতি ফজলুল হক ছাড়াও পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের উপস্থিতিতে নির্বাচনের মাঠ সরব করেছে। মাঠে নেমেছেন স্কয়ার গ্রুপের বিশিষ্ঠ শিল্পপতি মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু। কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতাদের উপস্থিতিতে প্রতিদিন ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়ায় নির্বাচনী পথসভা ও গণসংযোগ চলেছে। প্রচারণায় আওয়ামী লীগ ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
এদিকে বিএনপি প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিবের ধানের শীষের প্রচারণায় অংশ নিতে প্রথম দিকে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্য অনীহা পরিলক্ষিত হয়েছে। বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও পাবনা জেলা কমিটির আহব্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব মনোনয়ন পেলেও তৃণমূল নেতা-কর্মিরা অতীতের মতোই মূখ ফিরিয়ে নেয়। যেকারণে তাঁর নিজ গ্রামের বাড়ি সাহাপুর ও দুয়েকটি এলাকা ছাড়া দুই উপজেলায় ধানের শীষের তেমন পোষ্টার চোখে পড়েনি।
হাবিব আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগদানের পর থেকে তৃণমূলের বেশীরভাগই তাঁকে মেনে নিতে পারেননি। প্রায় ২০ বছর ধরে হাবিব বনাম সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম সরদারের দ্বন্দ্ব বিরাজমান। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও হাবিবের একই অবস্থা বিরাজমান ছিল। এখানকার সকল কমিটি ভেঙ্গে দেয়ায় নির্বাচনে সংকট অতীতের চেয়ে আরো বেশী ঘনীভূত হয়।
স্বৈরাচার পতনের পর ১৯৯১ সালে তদানিন্তন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাবিবকে এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থি সিরাজ সরদার বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ হাবিবকে মনোনয়ন না দিয়ে ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা জনাব শামসুর রহমান শরীফকে মনোনয়ন দিলে হাবিব এসময় বিএনপিতে  যোগদান করেন। হাবিব বিএনপিতে যোগ দিলেও ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৯ সালের নির্বাচনে সিরাজ সরদারকেই ধানের শীষের মনোনয়ন দেয়া হয়। ২০০১ সালে হাবিব বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থি হয়ে ‘কুড়াল’ প্রতিকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। এখান থেকেই তৃণমুল নেতাদের সাথে অর্ন্তদ্বন্দ্বের শুরু।
এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় নেতারা  তৃণমূল নেতা-কর্মীদের নির্বাচনের মাঠে নামানোর চেষ্টা করেও প্রথমদিকে নিস্ফল হয়েছেন। হাবিবের পক্ষে এক সপ্তাহ ধরে পথসভা ও কর্মিসভায় অংশ নিচ্ছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, দলের যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শিমূল বিশ্বাস, নাজিম উদ্দিন আলম প্রমুখ। দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব নিরসন করে গত ২৩শে সেপ্টেম্বর বুধবার ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির বিবদমান দু’গ্রুপের নেতা সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম সরদার ও প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব ঐক্যবদ্ধভাবে ধানের শীষের ভোট প্রার্থনা করছেন বলে জানিয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতারা সাংবাদিকদের সামনে ঐক্যবদ্ধ বিএনপিকে দৃশ্যমান করলেও বাস্তবে বেশীরভাগ নেতা-কর্মীকে ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়নি।
বিএনপি প্রার্থীর এই অবস্থার পরও গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক মন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান নির্বাচনী পথসভায় বলেন, উপনির্বাচনে ভোট কারচুপি ও ভোট সুষ্ঠু না হলে সরকারকে এজন্য কঠোর মাসুল দিতে হবে। আর ঈশ্বরদী থেকেই এবার সরকার বিরোধী ও পতনের আন্দোলন শুরু হবে। কেন্দ্রীয় সাংগাঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, উপনির্বাচনকে মাইলফলক হিসেবে নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। বিএনপি এই নির্বাচন এসিড টেষ্ট হিসেবে বিবেচনা করছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
ধানের শীষ প্রতিকের পোষ্টার ছিঁড়ে ফেলা, প্রচারনার মাইক ভাংচুর, বিএনপি কর্মীদের ওপর হামলা ও ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি, নেতা-কর্মীদের পুলিশী হয়রানি, মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের অভিযোগ করেছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব। মানুষ যদি ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে এবং ভোট যদি কারচুপি না হয়, তাহলে ধানের শীষের জয় হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
নৌকার নির্বাচনী অফিস ভাংচুর ও গুলি বর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রার্থী নূরুজ্জামান বিশ্বাস বলেন, হাবিব পোষ্টার লাগানো ও পোলিং এজন্টে দেয়ার লোক না পেয়ে বরাবরের মতো মিথ্যাচার করছে। নৌকার অফিসে গুলিবর্ষণের ঘটনা প্রসংগে তিনি বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে গুলির ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আগামী ২৬ তারিখে ব্যালটের মাধ্যমে এই বুলেটের জবাব দেয়া হবে। নির্বাচনকে ঘিরে  দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী বলে বিশ্বাস জানিয়েছেন।
বিএনপি’র প্রচারণার মাইক ভাংচুর ও পোষ্টার ছিঁড়ে ফেলা প্রসংগে থানার অফিসার ইনচার্জ সেখ নাসীর উদ্দিন জানান, এধরণের অভিযোগ পাওয়া পর তদন্ত করতে যেয়ে মাইক ভাংচুরের সত্যতা এবং পোষ্টার ছিঁড়ে ফেলার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নৌকার দুটি অফিস ভাংচুর ও গুলি বর্ষণের ঘটনায় থানায় দায়েরকৃত দুটি মামলায় ৫৬ নামীয় এবং অজ্ঞাত ৪৫ জনকে আসামী করা হয়েছে। মামলায় বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের আসামী করা হয়েছে কিনা জানিনা। তদন্ত করা হচ্ছে। এঘটনায় বিএনপি’র কোন নেতা-কর্মীকে  গ্রেফতার করা হয়নি এবং  পুলিশী হয়রানিও করা হচ্ছে না বলে তিনি জানিয়েছেন।
 এদিকে কিছু কিছু এলাকায় জাতীয় পার্টির প্রার্থী রেজাউল করিমের ‘লাঙ্গল’ প্রতীকের পোষ্টারও দেখা গেছে। জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী রেজাউল করিম খোকন বা তার দলের কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনী মাঠে সরব নয়। জাতীয় পার্টির একটি বড়ো অংশ নির্বাচনের মাঠে নেই।
করোনাকালে উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নূরুল হুদা নির্বাচনী এলাকা সফর ও কয়েকটি মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহন শেষে নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য তিনি বেশী গুরুত্বারোপ করেছেন। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে বলে সিইসি জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বারংবার প্রচারণা ও পথসভায় অংশগ্রহন করায় পাবনা-৪ আসনের এই উপনির্বাচন অনেক গুরুত্ব বহন করছে বলে পেশাজীবি সংগঠনগুলো মনে করছেন।