সাবেক পাকিস্তান আমলের কথা। পুর্ব-পাকিস্তানে তখন বাংলার সোনালী আঁশ হিসেবে খ্যাত প্রচুর পরিমাণে পাট উৎপন্ন হতো। আর বিলেতে পাট রপ্তাণির জন্য নারায়নগঞ্জ নদী বন্দ্রকে প্রাচ্যের ডান্ডি বলা হতো। সেই সময়কার কৃষিমন্ত্রী যশোর ভ্রমণ শেষে সড়ক পথে পাবনায় ফিরে পাবনা সার্কিট হাউজে কথা প্রসঙ্গে বলেন আসবার সময় কুষ্টিয়া এলাকার পথের দুধারে যে অধিক লম্বা এবং মোটা মোটা পাট দেখলাম তাতে আমি অভিভুত। মন্ত্রীর উচ্ছসিত কথায় সায় দিয়ে জনৈক রশিকজন বলেন, মন্ত্রী মহোদয় বোধহয় পাট আর ধনচে গাছকে পৃথক করতে পারেননি। আপনি যা দেখেছেন তা পাট লয় মন্ত্রী মহোদয় ওগুলো হলো ধনচে গাছ। একই জাতের তো তাই!!
সাবেক পাকিস্তান আমলের মন্ত্রীরা বাংলাদেশকে নিয়ে তেমন ভাবতেন না। তাই বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিলো যোজন যোজন ফারাক। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মন্ত্রী সভার সদস্যগণ সকলেই অতি বিচক্ষন বটে। কিন্তু তার মধ্যে দুএকজন মন্ত্রীর কান্ডজ্ঞান বর্জিত কথাবার্তা বা মন্তব্য সাধারণ মানুষের মনে দ্বিধা-দ্বন্দের সৃষ্টি করে বটে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথাই ধরা যাক। মহামারি করোনাভাইরাসের ছোবলে যখন গোটা জাতির ত্রাহি ত্রাহি রব তখন তিনি ফস করে বলে দিলেন, ‘করোনা এমনিতেই চলে যাবে। এর জন্য ভ্যাকসিনের প্রয়োজন নাও হতে পারে।’ আর এই কথা শোনার পর বাংলাদেশের মানুষ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যদিও প্রতিদিন মৃত্যুর খতিয়ানে তিরিশ- চল্লিশজন মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়ে চলেছেন তাতে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। করোনা বিদায় নিয়েছে এটাই সত্য। কথায় বলে,‘‘ হাটুরে লোকে কইছে চাচি, আরকি আমি মানুষ আছি?’’ এও যেন ঠিক তাই।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণের ছয়মাস পেরিয়ে গেছে চলতি মাসের ৩ তারিখে। এরপর ৪ তারিখে ২৯ জন, ৫ তারিখে ৩৫ জন, ৬ তারিখে ৩২ জন, ৭ তারিখে ৩৭ জন, ৮ তারিখে ৩৬জন, ৯ তারিখে ৪১ জন, ১০ সেপ্টেম্বরে ৪১ জন, ১১ সেপ্টেম্বরে ৩৪ জন, ১২ সেপ্টেম্বর ৩৪ জন, ১৩ তারিখে ৩১ জন এবং ১৪ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত্র হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৬ জন। জন হপকিন্স বিশ^বিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টারের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সোমবার (১৪/০৯/২০২০) তারিখ পর্যন্ত চীনে করোনায় মারা গেছেন ৪ হাজার ৭৩৪ জন। সে তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ৪ হাজার ৭৫৯ জন। তবে গত ২ আগস্টে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো সব চেয়ে কম অর্থাৎ মাত্র ২২ জন। আজ অর্থাৎ ১৪ আগষ্ট মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ২৬ জন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্ত্রীর কথায় কিংবা করোনার বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতিতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোন সুযোগ নেই। যে কোন সময় সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। মানুষের মধ্যে সর্বজনীন মাস্ক ব্যবহার, শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা, হ্যান্ড সেনিটাইজর ব্যবহার, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস বাড়ানো এবং পরীক্ষা ও আইসোলেশনের মতো স্বাস্থ্যবিধির কঠোর প্রয়োগের ওপর এ রোগের বিস্তার অনেকটা নির্ভর করবে। সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য না থাকলেও অনেকেই আশঙ্কা করছেন শীতকালের আবহাওয়ায় বাংলাদেশে সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। তাদের আশঙ্কা, আর্দ্রতা, সুর্যের তাপ, ভিটামিন ডি এর অভাব এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষতা কমে যাওয়াসহ শীতকালে অন্যান্য ভাইরাস ও ফ্লু জাতীয় শ^াসকষ্টের রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। তাই এসময় মানুষ করোনাভাইরাস নিয়ে বেশি সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে।
অপর দিকে শুরুর দিকে করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ভয়-ভীতি ছিলো এখন তা আর নেই বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। মানুষ অনেকটা বেপরোওয়াভাবে চলাফেরা করছে। মানুষের এই ঝুঁকিপুর্ণ আচরণ সংক্রমণ বাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ মানব কন্ঠকে বলেন, ‘‘ দেশে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমতির দিকে। কিন্তু এখন কম-বেশি বলা মুশকিল। এক মাস পরিস্থিতি দেখে বলা যাবে, কোন দিকে যাচ্ছে। ’’ তিনি বলেন,‘‘ এখন তো টেষ্ট কম হচ্ছে। জনগণও টেষ্ট করাতে অনীহা দেখাচ্ছে। টেষ্ট যদি বেশি বেশি করানো হয় তাহলে বোঝা যাবে করোনা কমছে কিনা। আগামী শীতে সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘ এটা বলা মুসকিল, করোনা নিয়ে তো আমাদের কোন অভিজ্ঞতা নেই। যখন আমাদের দেশে করোনা শুরু হয় তখন শীতকাল ছিলোনা। তবে তখন চীন এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে শীত ছিলো, সেখানে সংক্রমণও বেড়েছিলো। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি বাংলাদেশেও সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। ’’
হেলথ এন্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী মানব কন্ঠকে বলেন, ‘‘ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো পুরোটা নিয়ন্ত্রণে আসেনি, এমতাবস্থায় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অফিস-আদালত, কল-কারখানা, যানবাহন সব কিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে করোনার স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। মাস্ক ছাড়াই মানুষের চলাচল যেমন বেড়েছে তেমনি মানুষের মধ্যে নিরাপদ শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখতে অনীহা দেখা যাচ্ছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘ করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ঢিলেঢালা ভাব ও মানুষের মধ্যে অসচেতনতার ফলে যে কোন সময় করোনার সংক্রমণ হু হু করে বেড়ে যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশেই আমরা করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার এমন দৃশ্য দেখেছি।’’
করোন মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম বলেন,‘‘ দেশের করোনা সংক্রমণ একদিন বাড়ে একদিন কমে – এটা দেখে ভালো অবস্থা বলা যাবেনা। সামনে শীতকাল। শীতে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে বলা যাবেনা। শীতকে সামনে রেখে কর্ম পরিকল্পনা জরুরি। তিনি বলেন, আমরা লকডাউনে ব্যর্থ হয়েছি। এখন সব কিছু খুলে দিয়েছি। তাই সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে মাস্ক ব্যবহার করতেই হবে। নইলে সামনে বিপদ চলে আসতে পারে। ’’ (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।