‘বিশ্ব জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’ এই লাইনটি সংকল্প কবিতার একটি অংশ বিশেষ যা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা। ছোট্টদের পাঠ্য বইতে কবিতাটি আছে। প্রায় এক’শ বছর আগে তিনি এই কবিতাটি লিখেছিলেন। তখনতো আজকের মতো ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন কিংবা স্মার্টফোন ছিল না। এখন আধুনিক যুগে প্রায় সবার হাতে হাতেই স্মার্টফোন। আর স্মার্টফোনেই আছে ইন্টারনেট। আর ইন্টারনেট থাকা মানেই তো পুরো বিশ্বজগৎটাই হাতের মুঠোয়। জন্মগত ভাবেই শিশুরা কৌতুহলী। এই কৌতুহলী মনের কারণেই সময়ের পরিক্রমায় শিশুরা ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন ও সত্ত্বা নিয়ে বেড়ে উঠে। কেউ বিজ্ঞানী, কেউ দার্শনিক, কেউ প্রকৌশলী, কেউ চিকিৎসক, কেউ শিক্ষক। কিন্তু জগৎ দেখার জন্য শিশুদের তথা প্রত্যেকের নিজেদের তৈরী হতে হয়। পড়াশুনা করে নিজেকে তৈরী করে নিতে হয় জগতের মতো করে। যাতে কোন বাধা বিপত্তি এলে সেটা সামাল দিতে পারে। কাজী নজরুল ইসলাম অসাধারণ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তার রচনার পরিধি ছিল বিচিত্র। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ এই মানব মনের ব্যাথা বেদনা, চিরন্তন প্রেম বিরহের বাস্তব ছবি এঁকেছেন তিনি সার্থকভাবে। তার কাব্য প্রতিভা যেমন তাকে অন্যবদ্য কবিতা, গান, গজল, ইসলামী গান, কীর্তন রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। ঠিন তেমন করেই উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটক রচনা প্রণোদিত করেছে। তিনি তার মৌলিক অনুভুতি স্বাতন্ত্র ভাব প্রবণতা প্রবলবেগে প্রবাহিত করে জীবনের ব্যাথা জ্বালা ও দৈন্যের বিষ যন্ত্রণাকে নিপুন শিল্পীর মত রূপ দিতে সামর্থ্য হয়েছিলেন। তার এই বিদ্রোহী ও দুঃখবোধের যন্ত্রণা ভাবাবেগে লালিত নয়। এ যন্ত্রণাবোধ বাস্তব রক্তে মাংসে গড়া দুঃখ দৈন্য পীড়িত ব্যথাতুর মানব হৃদয়ের একান্ত অনুভুতি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখনী জীবন ছিল মাত্র পনের বা কুড়ি বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি মানব মনের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী আসন লাভ করে এদেশের জাতীয় কবির আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কবি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত রচনার মধ্যে মন্দির ও মসজিদ, হিন্দু, মুসলমান বাঙালীর বাংলা, যদি আর বাঁশী না বাজে, অসাধারণ এসব লেখনি আজও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ভাসিত। কবি নজরুল ইসলামের শিউলী মালা ছোট গল্প ছাড়াও হিংসাতুর, কবি রাণী, বিজয়িনী, চৈতী হাওয়া বিদ্রোহী সাম্যবাদী, পাপ, বীরঙ্গনা, নারী, এ মোর অহংকার ইত্যাদি কবিতা আজও একক আসন গেড়ে বসে আছে। কবি নজরুল ইসলাম ছোটদের জন্য লিখেছেন অনেক। বাংলা সাহিত্যের শিশুতোষ শাখাটি তার জাদুকরি হাতের ছোঁয়ায় পূর্ণ হয়েছে। শিশুদের জন্য রচিত তাঁর ছড়া, কবিতা, গল্প, গান, নাটক আজও সমান প্রিয় এবং চিরায়ত শিশু সাহিত্য হিসাবে সমাদৃত। শিশুতোষ রচনায় ঝিঙেফুল ও পুতুলের বিয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ছোটদের জন্য রচিত নজরুলের “চড়–ই পাখির ছানা” এই কবিতাটি সম্পর্কে কবিবন্ধু প্রখ্যাত কথাশিল্পী শৈলজানন্দ লিখেছেন- যে ছেলেটি পাখির ছানাটিকে মায়ের কাছে তুলে দিয়েছিল, সে নজরুল। তার কৈশোরের রচনাগুলো ছোট বড় সকলের জন্যই রচিত। কাজী নজরুল ইসলাম সকলের প্রিয় কবি। তাঁর সমগ্র রচনা বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তিনি চিরদিন আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে আনার পিছনে জাতির জনক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান চিরস্মরণীয়। কবির পরিবারের সদস্যদের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারের সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশে আনা সম্ভব হয়েছিল বলেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনস্থ কবরে শায়িত আছেন।
এবছরও চলে গেলো প্রিয় এই কবির প্রয়ান দিবস। হৃদয় মন অন্তর চিরে সবটা উজাড় করে দিলাম তাঁকে। মানব প্রেমের অকল্পনীয় নজির রেখে গেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার এই প্রয়ান দিবসে, কবির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ এবং তার বিদ্রোহী আত্মার প্রতি অকুন্ঠ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।
মোঃ রফিকুল ইসলাম
সহকারি অধ্যাপক
(পদার্থবিদ্যা বিভাগ)
সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া।