প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেক নাম পদ্মবিল

নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোর

প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য দেখে আমরা বিমোহিত হই।মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে পড়ে আমাদের মনজুড়ে। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার চিনিডাঙ্গার পদ্মবিল তেমনই ভালো লাগার আবেশ সৃষ্টি করে। বিল ভ্রমণে মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এখানে জলজ ফুলের রানী পদ্ম প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে উঠে মেলে ধরেছে আপন সৌন্দর্য। এতদিন অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল বিলটি। বিলের চারদিকে শুধু পদ্ম আর পদ্ম। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এ পদ্ম দেখলে মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এমন অপরূপ দৃশ্য ভ্রমণপিপাসুদের হাতছানি দেয়। বিলে ডিঙ্গি নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মনে পড়তে পারে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কেউ কথা রাখেনি কবিতাটি
মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলি বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর/তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব/সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে!/নাদের আলি, আমি আর কত বড় হব? আমার মাথা এই ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ ¯পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়/তিন প্রহরের বিল দেখাবে?


কবিতাটি পড়ে যাদের তিন প্রহরের বিল আর পদ্মফুল দেখার সাধ জন্মেছিল তারা কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পেতে পারেন বিল আর পদ্মফুল দেখার হাহাকার থেকে।সকালের দিকে ফোঁটা পদ্ম বেশি দেখা যায়। পড়ন্ত বিকালে ফুলের সঙ্গে অস্তগামী সূর্য আপনার মনের কাব্যিকতা বাড়িয়ে দেবে কয়েকগুণ। বিলের পাশে জেলে পল্লীর মানুষজন প্রবল উৎসাহে ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে ঘোরাবে। এখানকার মানুষ প্রবল অতিথিপরায়ণ। সারা বেলা ঘুরে নৌকার ভাড়া দিতে গেলে মুখ ফুটে কোনো দাবি করবে না। ১০০ থেকে ২০০ টাকা দিলে তো মহাখুশি। এখানকার মানুষ সবাই মতস্যজীবী। ফুলের দিকে বাড়তি নজর নেই কারও। ফলে পদ্ম ফুটে থাকে স্বগৌরবে।

কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা রাশেদা খাতুন সঙ্গে। তিনি জানান, শুধু ফুলের কারণেই চিনিডাঙ্গা বিলটি পরিচিত হয়েছে উঠছে। ধীরে ধীরে পরিচিত হওয়ায় ইতিমধ্যে পদ্মের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে বিলে আসতে শুরু করেছে দর্শণার্থী। ডিঙ্গি নৌকা করে বেড়ানোর কারণে বাড়তি আয়ও হচ্ছে স্থানীয়দের।

পারকোল গ্রামের কলিমুদ্দিন বলেন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যথাযথ প্রদক্ষেপ নিলে লোকচক্ষুর অন্তরালের চিনিডাঙ্গা বিলের সৌন্দর্যও বিকশিত হয়ে উঠতে পারে পর্যটনের অন্যতম স্থান।

বিল ভ্রমণে আসা ফারজানা কেয়া বলেন, নাটোরের চিনিডাঙ্গা বিল ঘুরতে এসেছি। অনেক সুন্দর একটি জায়গা। অনেক পদ্মফুল। নাটোর শহর থেকে একটু দূরে এত সুন্দর একটা জায়গা আছে, না এলে বুঝতে পারতাম না।কর্ম হারানোর বেদনায় থাকা এলাকার মৎস্যজীবীদের অনেকেই বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে নৌকায় দর্শনার্থীদের বিল দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ঘাটে নৌকা আছে পারকোল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিরও। এ নৌকায় বসে কথা হয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে। তাঁরা জানালেন, বড়াইগ্রাম উপজেলার পারকোল, মালিপাড়া আর আটোয়ার পাশ জুড়ে বিশাল এ বিলের অবস্থান। বিশাল এ বিলের মধ্যে প্রায় পাঁচশত একর জলকর সরকারী খাস খতিয়ানভূক্ত। বিলের মধ্যে দবিলা এলাকায় আছে পঞ্চাশ একরের এসএ রেকর্ডভূক্ত খাস খতিয়ানভুক্ত দিঘী। এ দিঘীই এক সময় ছিল এ বিলের চারপাশ জুড়ে থাকা প্রায় সাড়ে চার হাজার মৎস্যজীবীর আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সরকারের পক্ষে এলাকার মৎস্যজীবীরা লড়াই করেও এ দিঘী রক্ষা করতে পারেননি। দুষ্টুচক্রের সহযোগিতায় আর এস রেকর্ডে এ দিঘীর বেশ কিছু অংশ অবৈধভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডভূক্ত এবং কেনাবেচাও হয়ে গেছে। অবশিষ্ট বিল নাব্যতা হারিয়েছে। অথচ এ বিল খনন করে তৈরী করা যেত মা মাছের অভয়াশ্রম। এ অভয়াশ্রম থেকে সারা বিলে ছড়িয়ে পড়তো মাছের পোনা। সারা বিল হয়ে উঠতো মৎস্যজীবীদের মাছের আধার। মৎস্য বিভাগ প্রতি মৌসুমে বিলে মাত্র দুই মণ মাছের পোনা ছেড়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে।
এই বিলের এক সময়কার সভাপতি আজিজুল ইসলাম, পারকোল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ স¤পাদক ইসলাম উদ্দিনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের দাবি, বিলের দিঘী অবৈধ রেকর্ডভুক্তির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে দিঘী খনন করে মাছের অভয়াশ্রম তৈরী করতে হবে। উপজেলার ৬৪টি খাস জলাশয় প্রকৃত মৎস্যঝবিীদের নামে ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রশাসনকে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পক্ষিকূলের আশ্রয় ও খাদ্য নিশ্চিতকরণ প্রকল্পের সমন্বয়কারী যশোধন প্রামানিক বলেন, দেশের সকল জলাশয় তথা বিলগুলোকে মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার চেস্টা চলছে।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবু রায়হান জানান, মৎস্যজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণে নাটোরের চিনিডাঙ্গার বিলে সাত কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭৫ বিঘার একটি দিঘী পুনঃখনন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ বলেন, চিনিডাঙ্গার বিলে মৎস্যজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণে সর রকমের প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি দর্শনার্থীদের বিল ভ্রমণ সহজ ও সুন্দর করতে প্রশাসন সচেস্ট থাকবে।