নানা সমস্যা নিয়ে নাটোর পৌরসভা কার্যালয়ে মেয়র উমা চৌধুরী জলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন নানা স্তরের মানুষ। রবি থেকে বৃহস্পতিবার কাজের ফাঁকে পৌরসভার বিভিন্ন মানুষের সমস্যা সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন তিনি। নাটোর পৌরসভার দেড়শ’ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী মেয়র উমা চৌধুরী জলি। ২০১৬ সালের ১ মার্চে তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের নিয়েও কাজ করেন তিনি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সদস্য হিসেবে তৃণমূলের নারীদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তার দীর্ঘদিনের। মেয়র হিসেবে সেই অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। নারী অধিকারের ক্ষেত্রে তিনি মনে করেন নারীদের নিজেদেরও নিজেদেরকে তৈরি করতে হবে। নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সততার মাধ্যমে কাজ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। পুরুষের চেয়ে নারীরা দুর্নীতি কম করে। তবে তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে নারীরা একত্রিত হতে পারেন না। যে দেশে অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী সে দেশে নারীর ভোটেই নারী নির্বাচিত হতে পারেন। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষত স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য অর্থাৎ তারাও যে পুরুষের মতো এগিয়ে যেতে পারেন, সব কাজ করতে পারেন এ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে।
নাটোরের প্রথম নারী মেয়র হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কি ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন এ সম্পর্কে উমা চৌধুরী জলি বলেন, পৌরসভার নিজস্ব আয় থেকে কর্মচারীর বেতন-ভাতা, উৎসব ভাতা, বিদ্যুৎ বিল, শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, পৌরসভা সম্পর্কিত কাজ পরিচালনা করতে হয়। যা করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। সে জন্য জনগণের চাহিদা অনুযায়ী প্রত্যাশা পূরণ অনেক সময় সম্ভব হয় না। পৌরসভার উন্নয়ন কাজে সরকারি এডিপি অর্থাৎ উন্নয়ন বরাদ্দ বছরে যা পাই তা প্রয়োজনীয় কাজ চালানোর তুলনায় খুবই নগণ্য।
উমা চৌধুরী জলির জন্ম নাটোরের রাজনৈতিক পরিবারে। নাটোর শহরেই তার বেড়ে ওঠা। বাবা শংকর গোবিন্দ চৌধুরী ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭০ সালে তার বাবা নাটোর আসন থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন। দু’দুবার এমপি নির্বাচিত হন। পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। মা অনিমা চৌধুরী ছিলেন নাটোর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। নাটোর জেলা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মায়ের সঙ্গে তিনিও পড়াশোনার পাশাপাশি সব কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন। এভাবেই তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতি ও জনহিতকর কাজে সম্পৃক্ত হন।
উমা চৌধুরী জলি ১৯৮১ সালে নাটোর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। নাটোর মহিলা কলেজ থেকে ১৯৮৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। বিএ ভর্তি হন নাটোর এমএস কলেজে। পিডিপি’র ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় চলে যেতে হল শ্বশুরবাড়ী সিলেটে। সংসার সামলাতে গিয়ে পড়াশোনা আর এগোল না। ২০০৫ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর ফিরে এলেন বাপের বাড়ি। যুক্ত হলেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। নাটোর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের আহ্বায়ক ,সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সাকামের সভাপতি,নারদ বার্তার সম্পাদকএর দায়িত্ব পালন করেন। স্বামীর মৃত্যু শোক কাটতে না কাটতেই আরেকটি শোক তার জন্য অপেক্ষা করছিল। একমাত্র ছেলে দীপু চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ায় বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এর ওপর পড়ার সময়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ২০০৭ সালে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে ছেলে চলে যায় না ফেরার দেশে। একমাত্র মেয়ে দীপা চৌধুরী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে স্বামীর সঙ্গে কানাডা প্রবাসী।
দুস্থ নারীদের উন্নয়নে কাজ করছেন উমা চৌধুরী জলি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নাটোর পৌরসভার ‘বস্তি উন্নয়ন প্রকল্প’ রয়েছে। দরিদ্র নারীদের ঋণ দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব নারীদের সামান্য সুদে ঋণ প্রদান করা হয়। এই ঋণ নিয়ে কেউ সেলাই মেশিন কিনেছেন। কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন। আমি বিত্তবানদের কাছ থেকে সেলাই মেশিন সংগ্রহ করি নাটোরের পঙ্গু দুস্থ নারীদের জন্য। যারা সেলাই করতে পারেন তাদের মধ্যেই সেলাই মেশিন বিতরণ করেছি। প্রথম ব্যাচে দশ জন মেয়ে শিক্ষার্থী এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তাদের সার্টিফিকেট দেয়া হবে। এছাড়া যৌতুক, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে মহিলা কাউন্সিলরদের নিয়ে কাজ করছি। প্রতি ওয়ার্ডে উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা বাড়াচ্ছি। স্থানীয় সরকার থেকে পৌরসভায় যে বাজেট বরাদ্দ হয় তা নারী-পুরুষ কাউন্সিলরদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিই। মেয়র হিসেবে এই কাজগুলো পরিচালনা করতে এলাকার মানুষের সহযোগিতাও পাচ্ছি। তবে এলাকার উন্নয়নে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারছি না কেবল আর্থিক সমস্যার কারণে। রাস্তাঘাট, পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি নিরসনে এবং উন্নতমানের রাস্তাঘাট তৈরির জন্য যে অর্থ দরকার তা পেতে সমস্যা। এর ফলে ইচ্ছে থাকাসত্ত্বেও কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।এছাড়া করোনার শুরু থেকে তিনি ব্যাপক খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন।