দেশে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় প্রথম সারির যোদ্ধা চিকিৎসাক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা রয়েছেন মৃত্যু ঝুঁকিতে। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অনিয়ম দূর্নীতিকে। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভয়াবহ অনিয়ম ও দূর্নীতি ইতিমধ্যে জনসম্মুখে বেরিয়ে এসেছে। একটি স্বাধীন দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার এ রকম বেহাল দশা দেখে জনমনে নানা রহম প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের এক শ্রেণির অসৎ নেতা-কর্মীদের ছত্রছাঁয়ায় দেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে উঠেছে অপরাধী চক্রের সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট চক্রটি ব্যাপক অনিয়ম-দূর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে সল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। অপর দিকে দেশের ১৬ কোটি মানুষ এখন তাদের প্রাপ্য নাগরীক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। স্বাধীন দেশে এ রকম অবস্থা কারো কাম্য ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী অনেক মানুষ এরকম বেহালাপনা দশার কারণ হিসেবে দায়ী করছেন চলমান সমাজ ব্যবস্থাকে। তারা মনে করছেন, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এরকম দূর্নীতি-অনিয়ম সম্পূর্ণভাবে নির্মুল করা সম্ভব নয়।
করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট এমন সংকট নিকট অতীতে আর দেখেনি মানুষ। মহামারীতে স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্র। বিশ্ব সম্প্রদায়ের মতো আক্রান্ত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ইতিমধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে ২৬ জুলাই আরও ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজার ৯ শতে ছড়ালো। ২৬ জুলাই সংক্রমন শনাক্তের ১৪১ দিনে দেশে মোট ২ হাজার ৯ শত ২৮ জনের মৃত্যু তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ব্যাপক অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ হওয়ার পর ২১ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেছে। পরদিন পরিচালক ডা. আমিনুল হাসানকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২৩ জুলাই ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের সার্জারী বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন মহা-পরিচালক (ডিজি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ)- এর মহা সচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী গণমাধ্যমে স্বাক্ষাতকারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দূর্নীতি স্বেচ্ছাচারিতা ও সমন্বয়হীনতার অবসান চেয়েছেন। দেশের এই বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কার্যকরি পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি জীবিকা নিশ্চিত করতে নিয়েছেন নানা রকম পদক্ষেপ। দেশের অর্থনীতি চালু রাখতে তিনি ঘোষণা করেছেন নানা রকম প্রনোদনা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ায় আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং সংস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।
রাজধানীর মালিবাগ প্রশান্তি হাসপাতালে কথিত- আইসিইউ-তে হাত বেঁধে রাখা হয় মৃত ব্যক্তিকে। টাকার জন্য আটক করে রাখা হয় লাশ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ দৃশ্য দেশবাসী অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন। রিজেন্ট হাসপাতালের রেজি: না থাকলেও করোনা চিকিৎসার চুক্তিপত্র করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চুক্তিপত্র স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এখন থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ার কারণে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন একে অপরের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত মন্তব্য কলামে বলেছেন, করোনাকাল শুরু হওয়ার পর থেকে স্বাস্থমন্ত্রণালয়ের পর্বতপ্রমাণ দূর্নীতি ও নৈরাজ্যের যে ছবি জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়েছে তা দিয়ে কয়েক ডর্জন পিএইচডি’র থিচিছ লেখা যেতে পারে। তিনি আরও বলেছেন, সবচেয়ে ভৌতিক ঘটনা হলো, আইনের দৃষ্টিতে অস্তিস্তহীন রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে অবৈধ চুক্তি করে সেই ভূঁয়া হাসপাতালকে আকাশচুম্বী অবৈধ মুনাফার ব্যবস্থা করে দেওয়া। স্বীকৃত মতে এই ভূঁয়া হাসপাতালটি বিগত ৬ বছর ধরে লাইসেন্সবিহীনভাবে মহা দাপটের সঙ্গে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে বাণিজ্য করছে স্বা¯মন্ত্রণালয়ের জ্ঞাতসারে। যে হাসপাতালটি লাইসেন্স নবায়ন করেনি সেটি সোজা কথা লাইসেন্সবিহীন। যাকে আইনগতভাবে মোটেও হাসপাতাল বলা যায় না। তিনি বলেছেন, স্বা¯মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অবৈধ চুক্তির ভিত্তিতে ওই হাসপাতলটি করোনা মুক্ত সনদ প্রদান করতো অনেক টাকার বিনিময়ে। অপরাধমূলক এ কর্মকান্ডে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে রোগী, অপর দিকে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে দেশের ভাবমূর্তি।
এতবড় প্রতারক হয়েও কিভাবে সাহেদ এতোদিন প্রতারনা করে আসছে। প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কারা নেপথ্যের গডফাদার ছিলেন তাদের বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এ ঘটনাকে ইঁদুর বেড়ালের খেলা বলে উল্লেখ্য করেছেন বিএসএমএমইউ-এর সাবেক ভাইস চ্যাঞ্চেলর অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান।
ছদ্দবেশ ধারণ করে ভারতে পালানোর সময় গত ১৫ জুলাই ভোরবেলা সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে র্যাবের অভিযানে অস্ত্রসহ ধরা পড়েছে বহু অপকর্মের হোতা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ। চিকিৎসা সেবার নামে ভয়াবহ প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনায় আলোচিত দুই চরিত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদত্যাগকৃত মহা-পরিচালক (ডিজি) আবুল কালাম আজাদ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে দূর্নীতি দমন কমিশন দুদক।
দু’একজন কর্মকর্তা বদলি করে স্বাস্থ্য প্রশাসনের সংকট কাটবেনা; পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কাঠামো বদলাতে হবে। রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের তদবিরের নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি বন্ধ করার পরামর্শ দিয়ে দেশের বিশিষ্ট চিকিৎকরা বলেছেন, দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অব্যবস্থপনা ও দূর্নীতি রাতারাতি সমাধান করা যাবে না। পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দূর্নীতিগ্রস্থ এবং অনভিজ্ঞ জনবল দ্বারা পালিচালিত হচ্ছে। কাজেই পুরো প্রশাসনই ঢেলে সাজাতে হবে। প্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা চেইন অব কমান্ড থাকতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধিন সব নিয়োগ, বদলি এবং পদায়ন স্বাভাবিক নিয়মে হতে হবে। এগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বস্তরে সব কর্মকর্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘স্বাস্থ্যের পুরো সিস্টেম পাল্টাতে হবে। এক, দু’জন লোক পাল্টিয়ে কিছুই হবে না। এখন যাকে মহা-পরিচালক (ডিজি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনি একজন দক্ষ সার্জন। তাছাড়া তার চাকুরীও আছে মাত্র কয়েক মাস। এই পরিস্থিতিতে তিনি কী করতে পারবেন, আমি জানি না। ’
দেশে করোনা সংক্রমণের হার ঝুঁকিমুক্ত নয়। সামনে ঈদুল আজহার ছুটি ও পশু হাটের ভীড় এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে এমন আশংকা রয়েছে। দেশবাসী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অনিয়ম-দূর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসান চায়।
লেখক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকার কর্মী।