বৈশি^ক করোনা মহামারিতে সারা বিশে^র ১১৩টি দেশ ও অঞ্চলের লাখো-কোটি মানুষ আজ অসহায়ত্বের শিকলে বন্দি। এই করোনাকালে মানুষের জীবন ধারাই আমূল পাল্টে গেছে। অনেকের দীর্ঘদিনের সঞ্চিত অর্থে টান পড়েছে। চাকরি হারিয়ে কেউ বেকারের খাতায় নাম লিখেয়েছে।
অভাবের তাড়নায় অনেকেই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। পরিবারের অতি আপনজনের অকাল জীবনাবসানে আনন্দমুখর সংসার ভেঙে খান খান হয়েছে। অনেকের বুকের পাঁজর ভেঙেছে। ধর্মীয় রীতি অনুসারে
মরদেহের সৎকার করা সম্ভব হয়নি। মৃত্যুর পর অনেক ক্ষেত্রেই শেষ দেখার সুযোগও হয়নি। কেউ কেউ আবার করোনার কারনে করুনভাবে এ ধরায় বেঁচে আছে। কেউবা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে পাঞ্জা।
এমনিভাবে হতাশায় নিমজ্জিত করোনাকালের জীবন ধারায় বিলম্বে হলেও আশার আলো দেখিয়েছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদল। গত ২০ জুলাই রয়টার্স পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে অক্সফোর্ড
ইউনিভার্সিটির গবেষকদের তৈরি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ প্রাথমিকভাবে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। গবেষকরা বলেছেন, মানব
দেহে প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনটি নিরাপদ। তবে পুরোপুরি নিরাপদ ঘোষণা করার জন্য আরো পরীক্ষার প্রয়োজন আছে। বলা হচ্ছে এই
ভ্যাকসিনটি নতুন করোনাভাইরাসের বিরুেেদ্ধ মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কার্যকর করে তুলতে সহায়তা করে। ফলাফলে দেখা
গেছে, পরীক্ষার ৫৬ দিন পর্যন্ত শক্তিশালী অ্যান্টিবডি উৎপাদন ও টি-সেল
রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পর এ ফল আরো বেশি হতে পারে। আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্ণাল ল্যানসেটে ভ্যাকসিনটির প্রথম ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল প্রতিবেদনে এ
তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তবে দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিক্যিাল ট্রায়ালের ফল প্রকাশের পরই এটা বাজারজাত করা হবে।
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে,অক্সেফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি ভ্যাকসিনটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল
প্রকাশ করে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ৭৭ জনের উপর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়। জানা যায়, একই ধরণের ভাইরাসের ক্ষেত্রে আগে যে,ওষুধ কার্যকর হয়েছিলো তার উপর ভিত্তি করেই অক্সফোর্ডের গবেষকরা অধ্যাপক সারা গিলবার্টের নেতৃত্বে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু করেন। ভ্যাকসিনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘এজেডডি১২২২। এজেডডি১২২২ ভ্যাকসিনটি তৈরির পেছনে মূল কাজ করেছে বৃটেনের অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়। ব্রিটেন-সুইডিস কোম্পানি
অ্যাস্ট্রাজেনেকাফার্মাসিটিউক্যাল পার্টনার হিসেবে এই ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বন্টনের কাজ করছে। বিশ^বাসি যেন খুব দ্রুতই এই
ভ্যাকসিন পেতে পারে এজন্য ক্লিনিক্যিাল ট্রায়ালের মধ্যেই ভ্যাকসিনের উৎপাদন শুরু করেছে অ্যাসট্্রাজেনেকা। খুব তাড়াতাড়ি ২০০ কোটি ডোজ করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বন্টন করতে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
এর মধ্যে ৪০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বরাদ্দ থাকছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের জন্য। আর নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য থাকছে ১০০ কোটি ডোজ। প্রথমে পাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। এরপর আগামি নতুন বছরের শুরুতেই বিশ^ব্যাপি বন্টন করা হবে এ ভ্যাকসিন। অ্যাস্ট্রাজেনেকার সিইও প্যাসক্যাল সোরিয়েট বলেন, নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে ১০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বন্টনের জন্য এরই মধ্যে ভারতীয় কোম্পানি সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছ্।ে এর
উৎপাদন হবে ব্রাজিলেও। বছরের শেষ দিকে ৪০ কোটি ডোজ হস্তান্তর করা হবে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এ ভ্যাকসিনের দাম হাতের নাগালের মধ্যেই রাখা হবে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা বলছে, তারা কয়েক শ কোটি ভ্যাকসিন তৈরি করতে যাচ্ছে। আর প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের দাম রাখা হতে পারে এক কাপ কফির দামের সমান।
বিশে^ করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে সবার আগে তা বাংলাদেশে আসবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল
মান্নান। সচিব বলেন, যুক্তরাজ্য, চীনসহ অনেক দেশই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দারপ্রান্তে রয়েছে। তথ্য মতে বিশে^র যেসব দেশে
মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলারের নিচে সেসব দেশ এ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে পাবে। যেহেতু বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় ২ হাজার
ডলারের কাছাকাছি, সুতরাং বাংলাদেশ এ ভ্যাকসিন বিনামূলেই পেয়ে যাবে। গত ২০ জুলাই সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনলাইন ভিত্তিক মিটিং প্লাটফরম ‘ জুম’ এর মাধ্যমে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটিরি এক বিশেষ সভায় সভাপতির বক্তব্যে সচিব এসব কথা বলেন। অনলাইন সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম
আজাদ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শেখ মুজিবর রহমানসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভার কার্যক্রম সঞ্চালনের দায়িত্বে ছিলেন জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
কথায় বলে ‘ যে সাপে দংশন করে সেই সাপের দ্বারাই বিষ নামে।’
করোনাভাইরাসের বেলাতেও তাই হয়েছে বলা চলে। কারণ এই কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হলো চীনের উহান প্রদেশ। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এই মারণব্যাধি সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
এই করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক এপর্যন্ত কোন দেশই আবিষ্কার করতে পারেনি। চীনই এব্যাপারে মুরুব্বির ভুমিকা পালন করে চলেছে। কারণ বাংলাদেশে চীনের সিনোভেক কোম্পানির তৈরি করোনা ভাইরাসের (
কোভিড-১৯ ) ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর নৈতিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্স
কাউন্সিল (বিএমআরসি) এ অনুমোদন দিয়েছে। সিনোভেকের টিকার সম্ভাব্য নাম‘ করোনাভেক’। দেশের ৭ টি হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মিদের ওপর এ ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চালাবে আইসিডিডিআরবি। মোট ২ হাজার ১০০ জনের ওপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে।
বিএমআরসির পরিচালক মাহমুদ উজ্জামান বলেন, ‘ চীনের সিনোভেক রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড কোম্পানির তৈরি টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের জন্য প্রায় ১ মাস আগে আইসিডিডিআরবি আমাদের কাছে প্রটোকল জমা দিয়েছিলো।
এটি ন্যাশনাল রিসার্চ এথিকস কমিটি নৈতিক অনুমোদন দিয়েছ্ েতারা যেসব প্রতিষ্ঠানে এসব ট্রায়াল চালাবে এখন সেগুলোর
প্রশাসনিক অনুমোদন নেবে।’ তিনি জানান,
আইসিডিডিআরবির জমা দেওয়া প্রটোকলে ৪ হাজার ২০০ জনের ওপর এটির প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। তবে গবেষণার নিয়ম অনুযায়ী
তাদের মধ্যে অর্ধেক টিকা পাবেন, অর্ধেক পাবেননা। বিএমআরসির পরিচালক আরো জানান, আইসিডিডিআরবি যে ৭ টি হাসপাতালে টিকা পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে অনুমোদন চেয়েছে ,
সেগুলো হলো মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বার্ণ ইউনিট-১ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত-
বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইউনিট-২ এবং ঢাকা মহানগর হাসপাতাল।।
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক
ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১