বিখ্যাত প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত, ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ বিএনপির সময় বিএনপি, আর আওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগ হয়ে যান। হাওয়া ভবনে তার যাতায়াত ছিলো।
বিএনপি আমলে রাজাকার মীর কাসেম আলী ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। খাম্বা মামুনের সঙ্গে সে ২ বছর
জেলও খেটেছেন। ২০১১ সালে ধানমন্ডির ১৫ নম্বর রোডে এমএল এম কো বিডিএস ক্লিক ওয়ানের ব্যবসা করে সাধারণ মানুষের ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৩২ টি মামলা রয়েছে। অন্য দিকে নিজেকে কর্ণেল (অব.) পরিচয় দিয়ে মার্কেন্টাইল কোঅপারেটিভ ব্যাংক বিমান বন্দর শাখা থেকে ৩ কোটি টাকা লোন নেওয়া নিয়েও তারবিরুদ্ধে আদালতে দুটি মামলা চলছে। বিভিন্ন টিভির টকশোতে মোহাম্মদ সাহেদকে দেখা যেতো। তার প্রতিষ্ঠান কেসিএস লি. এর নামে ইউসিবি ব্যাংক উত্তরা শাখাসহ বিভিন্ন ব্যাংকে শত শত কোটি টাকা রয়েছে বলে জানা গেছে।
সাতক্ষীরার ছেলে সাহেদ স্কুলের শেষ দিকের ছাত্র থাকাবস্থায় ঢাকায় চল আসেন। তার মা সুফিয়া করিম একসময় মহিলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাবা সিরাজুল করিম ছিলেন ব্যবসায়ী। শহরের কামালনগরে করিম সুপারমার্কেট নামে একটি বিপণি বিতান ছিলো তাদের। সাহেদের মা মারা যাবার পর তার বাবা ঐ ব্যবসা প্রতিষ্টান বিক্রি
করে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। সাহেদ আওয়মী লীগ আমলে প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। বেশ কয়েক বছর আগে থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতাদের বাসায় তার যাতয়াত শুরু
হয় বলে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের বিগত কমিটির সহ প্রচার সম্পাদক আজিজুল হক রানা জানান। চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী এক ফেইসবুক পোষ্টে লিখেছেন, এতো গোয়েন্দা সংস্থা, আইন শৃঙ্খলা
বাহিনী, সরকারি বিভাগ সবাইকে ফাঁকি দিলো লোকটা। তার মানে সবাইকে সে ম্যানেজ করে ফেলেছে। মন্ত্রী, সচিবের পাশে বসে থাকে!
’’ গত কয়েক বছর ধরে টেলিভিশন টকশোতে নিয়মিত হাজির হওয়া মোহাম্মদ সাহেদ দৈনিক নতুন কাগজ নামে একটি পত্রিকাও খুলেছেন
সম্প্রতি। তিনি সেই কাগজের সম্পাদক ও প্রকাশক। উত্তরা মিডিয়া ক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেও পরিচয় দিতেন তিনি। রাঘব
বোয়ালদের আস্কারা পেয়েই সাহেদ দিন দিন অপকর্মের হোতা বনে গেছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, সাহেদের কাছের কয়েকজন ব্যক্তি জানান, তার কাছে ধরা খেয়েছেন রাজউকের সাবেক এক চেয়ারম্যানও। ঐ চেয়ারম্যান ৯ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নিলে তা জানতে পারে সাহেদ। এরপর শুরু হয় তাকে ফাঁদে ফেলার এবং তাকে ব্ল্যাকমেইলের পর্ব। প্রয়ি দিনই তারা অভিজাত হোটেলে সোনারগাঁয়ে বসতেন। বসার আগে সাহেদ বিভন্ন লামছাম পত্রিকার লোগো এবং তার কম্পিউটারে এনএসআইএর প্রতিবেদন বানিয়ে তা ঐ চেয়ারম্যানকে দেখাতেন। এছাড়াও তাকে বাজউকের
চেয়ারম্যান বানাতে তদবির করবে বলে বিভিন্ন সময়ে তার কাছ থেকে কোটি টাকা নিয়ে নেয়। এঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ‘সময়ের
আলো’কে বলেন, ঐ স্যারের কাছ থেকে আমি যতদুর জানি প্রায় ৫ কোটি টাকা সে নিয়েছে। ঐ স্যারকে বার বার ভুয়া নিউজ ও
এনএসআইএর প্রতিবেদন দেখিয়ে টাকা আদায় করতেন সাহেদ। তারা অজ¯্রবার হোটেলে দেখাও করেছেন।
সাহেদের আরেক সহযোগী ও ঘনিষ্ঠজন জানান, ২০১৭ সালের দিকে মেগা মোটরসের মালিকের ১ হাজার সিএনজির অনুমোদন নিয়ে দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই সাহেদ।
পরে আর সেই টাকা আদায় করতে পারেননি সেই ব্যক্তি। ব্যবসায়ী, চিকিৎসক ও সাবেক আমলার পাশাপাশি এক বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও
সংবাদকর্মী আমিরুল মোমেনীন মানিক প্রতারণার শিকার হন বলে তিনি তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি
স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন, ২০০৭ সালে দিকে বিডিএস কুরিয়ারের নামে একটি জ্ঞিাপন তৈরি করে দিয়েছিলেন। যার জন্য তার সঙ্গে চুক্তি
হয়েছিলো ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু শুরুতে মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে ঘুরাতে শুরু করে সাহেদ ও তার লোকজন। একদিন তিনি ধানমন্ডির জিগাতলায় থাকা সেই সময়ে বিডিএস কুরিয়ারের অফিসে টাকা চাইতে গেলে তাকে ১ ঘন্টা বসিয়ে রেখে মাত্র ১০ হাজর টাকা দিতে
রাজি হন। কিন্তু মানিক সেদিন সেই টাকা সাহেদের মুখের ওপর ফেলে দিয়ে চলে এসেছিলেন। মানিক আরো জানান, সেদিন তাকে সাহেদ একজন মেজর বলে পরিচয় দিয়ে নানা হুমকি দিয়েছিলেন। এরপর সেই
টাকা আর তিনি কোন সময়ই পাননি।
এছাড়া সাহেদের দখলে থাকা ‘নতুন কাগজ’এর সম্পাদক ছিলেন আরেক
ব্যক্তি। কাগজটি কেনার নাম করে সেটি দখল করে নেয় সাহেদ। কিছু টাকা দিয়েছিলো ঐ ব্যক্তিকে। এরপর তাকে আর কোন টাকা দেওয়াই হয়নি বলে জানা গেছে। এসব মানুষের পাশাপাশি সাহেদ আব্দুল বাতেন
নামে এক আইনজীবীর সাথেও প্রতারণা করেন। উত্তরায় ১৭ নম্বর বাড়িতে তার অফিস পরিচালনা করতেন সাহেদ। সেই বাসার বাড়া বাবদ ঐ ব্যক্তি তার কাছে ১৬ লাখ টাকা পেতেন। টাকা না পেয়ে পরবর্তীতে সেই ব্যক্তি
সাহেদের নামে মামলা করে বলেও পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে। নারী কেলেঙ্কারিতে শীর্ষে ছিলো সাহেদ। সাহেদ একজন শুধু প্রতারকই
নয়, বড় ধরণের নারীলোভি ব্যক্তিও ছিলেন। তার নারী কেং্কোরির কথা অফিসের সকলেই জানতেন। কিন্তু কেউ মুখ খুলতেননা।
করোনার নমুনা পরীক্ষার নামে প্রতারণার অভিযোগে দেশ জুড়ে আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ গ্রেফতার
এড়াতে আত্মগোপনে আছেন। তাকে গ্রেফতারের জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করেে চলেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘‘সাহেদকে কোনভাবেই ছাড় দেওয়া হবেনা। তিনি বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি যে ধরণের অপরাধ করেছেন তাতে কোনভাবেই ছাড় দেওয়া হবেনা। গত ১০ জুলাই দুপুরে তিনি তার ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের একথা বলেন। স্বরাষ্্রমন্ত্রী
বলেন, সাহেদ কোন দল বা গোষ্টির সেটা বিষয়না। অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, যেখানে সারা দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, সেখানে
রিজেন্ট হাসপাতাল মানুষের সঙ্গে যে প্রতারণা করেছে তা কোনভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায়না। এধরণের অপরাধীকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।
আমরা সেই ব্যবস্থাই করবো।’’ রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি তার জন্মদাতা পিতার সঙ্গেও
প্রতারণা করেছেন। করোনা আক্রান্ত পিতাকে মিথ্যা নেগেটিভ সনদ দেখিয়ে ভর্তি করান অন্য একটি হাসপাতালে। অসুস্থ্য পিতা তাকে
প্রশ্ন করেছিলেন, নিজের হাসপাতাল রেখে তাকে চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে কেন? তার উত্তরে সাহেদ বলেছিলেন তার হাসপাতালের চেয়ে এই হাসপাতাল বেশি উন্নত। হাসপাতালে ভর্তির পর পরীক্ষায় তার পিতার পজিটিভ ধরা পড়ে এবং সেই হাসপাতালেই তার মৃত্যু
হয়। রিজেন্ট হাসপাতাল সিগালা করার পর তিনি পলাতক। তার পিতার মৃত্যুর পর তার কোন খবর নেননি সাহেদ। এমনকি দাফনেরও ব্যবস্থা তিনি করেননি। জাল-জালিয়াতির প্রধান আসামি সাহেদ আজ পলাতক।
কিন্তু এক সময়ে তার সখ্যতা ছিলো একাধিক মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ উর্দ্ধতন মহলের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে। বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক ছবিতে তার প্রমাণ মেলে। যে, পুলিশ বাহিনী এখন তাকে গরু খোঁজা করে খুঁজে খুঁজে হয়রান পেরেশান হচ্ছে। সেই পুলিশ
বাহিনীর শীর্ষ কর্তাব্যক্তির সঙ্গেও সাহেদের ছবি গনমাধমে প্রকাশিত হয়েছে।
সর্ব শেষ খবর, ১৫ জুলাই ভোরবেলা সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর বেইলি ব্রিজের পাশে নর্দমার মধ্য থেকে শার্ট, প্যান্ট ও বোরকা পরা অবস্থায় র্যাব কর্তৃক সাহেদ করিমকে গ্রেফতার করা হয়।
তিনি ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। র্যাব জানায় তার কাছে একটি অবৈধ অস্ত্র ছিলো।
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।