বিশ্বনাথে অফিস সহকারীর আত্নহত্যা রহস্যজনক ‘স্বামী-স্ত্রী ছাড়া স্কুলের হিসাবের জন্য চাপ প্রয়োগের ব্যাপারে জানতেন না আর কেউ’


বিশ্বনাথ প্রতিনিধি :: হারপিক খেয়ে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ‘আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের’ অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলা (৪০)’র আত্নহত্যায় ঘটনায় এলাকায় রহস্যজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এনিয়ে আসমার পিতা-স্বামীর বাড়ির লোকজন ও স্কুল কমিটির নেতৃবৃন্দ করছেন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। আবার আসল ঘটনাকে আড়াল করে তৃতীয় একটি পক্ষ এবিষয়কে কেন্দ্র করে স্কুল ধ্বংস করার পায়তারা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের ফলে এলাকার বিরাজ করছে গ্রেফতার আতংঙ্ক।আসমার আত্নহত্যার পর তার স্বামী দৌলতপুর ইউনিয়নের বাহাড় দুভাগ গ্রামের ফজলুর রহমান বাদী হয়ে স্কুলের গভনিং বডির ২ সদস্য ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের নাম উল্লেখ এবং আরো ৭ জনকে অজ্ঞাতনামা অভিযুক্ত করে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযুক্তরা হলেন স্কুল গভর্নিং বডির সদস্য দৌলতপুর গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা এম এ রউফ (৬৫), আনোয়ার মিয়া (৪৫), ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চরশ্রীরামপুর গ্রামের হাসিম উদ্দিন (৬০)। ইতিমধ্যে আনোয়ার মিয়াকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।আসমার (পিতা-স্বামীর) পরিবারের দাবী, আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের বিগত ৩ বছরের হিসাব দেওয়ার জন্য ১৮ জুন গঠিত প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির কয়েক জন সদস্য অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলাকে চাপ প্রয়োগ ও অপমান করেন একাধিকবার। এমনকি নিজেদের পছন্দের মানুষকে চাকুরী দেওয়ার জন্য কলেজ শাখার অফিস সহকারীর পদ থেকে আসমাকে বাদ দেওয়া হয়। আর এসব অপমান সহ্য করতে না পেরে ৬ জুলাই ২.১৫ মিনিটের দিকে নিজ বাসার (ভাড়াটিয়া) বাতরুমে আত্নহত্যার উদ্দেশ্যে হারপিক পান করেন তিনি। এরপর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ জুলাই ভোররাতে আসমা মৃত্যুবরণ করেন।স্কুল কমিটির দাবী, পারিবারিক কলহের জের ধরে প্রায় ১০ মাস পূর্বে স্বামী-সন্তানসহ আসমাকে নিজ বাড়ি থেকে বের করে দেন তার (আসমা) দেবর ও স্থানীয় ওয়ার্ডের মেম্বার তালুকদার শাহীন আহমদ। বিগত ঈদের দিন আসমা স্বামী-সন্তান নিয়ে বাড়িতে গেলে তাদেরকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করেন দেন শাহীন। যা আসমা নিজ মুখে গভর্নিং বডির অনেককে বলেছেন। আর পারিবারিক কলহ চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকার কারণে মৃত্যুর পরও স্বামীর বাড়ির কবরস্থানে আসমার লাশ দাফন করা হয়নি, হয়েছে পিতার বাড়ির কবরস্থানে। আর বিধিমতে প্রতিষ্ঠানের হিসাব সাবেক কমিটি বর্তমান কমিটির কাছে হস্তান্তর করবে, এখানে অফিস সহকারীর কাছে হিসাব চাওয়া অযৌক্তিক ও অবৈধ। যদি গভর্নিং বডির নেতৃবৃন্দ তার সাথে বার বার ওই অবৈধ ও অযৌক্তিক কাজ করে থাকেন তা হলে তিনি (আসমা) কেন বিষয়টি উনার দেবর (শাহীন) ও স্থানীয় মেম্বার বা চেয়ারম্যান বা এলাকার গন্যমান্য বা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বা ইউএনও’র কাছে অভিযোগ অথবা তাদেরকে অবহিত করলেন না। তারা (ফজলুর-আসমা) স্বামী-স্ত্রী ছাড়া প্রতিষ্ঠানের হিসাবের জন্য চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে আর কেউ জানেন না।   আসমার স্বামী ফজলুর রহমান বলেন, আমাদের পারিবারিক কোন কলহ নেই। স্কুলে যাতায়াতের সুবিধার জন্য স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছি। আমার ভাই কর্তৃক বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগটি মিথ্যা-বানোয়াট। আসমা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের একটি দূর্নীতি ধরে দিলেও গভর্নিং বডি তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং আমার (ফজলুর) সামনেই গভর্নিং বডির সদস্য আনোয়ার আসমাকে চড় মেরে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন এবং হিসাব ঠিক না থাকলে তার পিতার গলায় চাপ দিয়ে টাকা উদ্ধার করার হুমকি দেন সভাপতি। অধ্যক্ষের দূর্নীতি যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য আসমাকে কলেজ শাখার অফিস সহকারীর পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। আমরা চেয়ে ছিলাম বাইরের কাউকে না জানিয়ে বিষয়টি শেষ করতে, আর তাই নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্য কাউকে এব্যাপারে জানানো হয়নি।স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি দল সোমবার সরেজমিনে এলাকায় গেলে উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ পেলেও প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাসিম উদ্দিনের দেখা পাননি। তবে এঘটনায় যাতে কাউকে অযথা হয়রাণী না করা হয় সেজন্য প্রশাসন ও সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করে সুষ্ঠ তদন্তের দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী।প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য কর্তৃক অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলাকে অবৈধভাবে হিসাব দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে তার (আসমা) মৃত্যুর পূর্বে জানতেন না বা জানানো হয়নি বলে স্বীকার করেছেন আসমার দেবর ও স্থানীয় মেম্বার তালুকদার শাহীন আহমদ, যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছোট ভাই স্বপন শিকদার। তবে সুষ্ট তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধীর শাস্তি দাবী করেন তারা।নব-গঠিত কমিটির ৩ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য জামাল উদ্দিন বলেন, প্রতিবেশি হওয়ার সুবাধে প্রতিদিন ৪/৫ বার তাদের (আসমা-ফজলুর) সাথে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু কোন দিনই তাদের মুখে প্রতিষ্ঠানের হিসাবের জন্য নতুন কমিটির সদস্য কর্তৃক তাকে অবৈধ চাপ প্রয়োগের কথা শুনি নি। আসমার আত্নহত্যা করার আসল রহসৎ উদঘাটন হওয়া জরুরী।  আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা এম এ রউফ বলেন, আসমা আমার মেয়ের মতো হওয়াতে সে প্রায়ই নিজের পারিবারিক কলহের কথা আমাকে বলত। নিজেও মানসিক চাপে ভোগতো। তাই আমি তাকে নিজের সাধ্যমতো শান্তনা দিতাম। প্রতিষ্ঠানের হিসাব তার কাছে যাওয়া বা এজন্য তাকে চাপ দেওয়া একটি অবৈধ কাজ। আর আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন অবৈধ কাজ করতে পারি না। পূর্বের কমিটি আমাদের কাছে ৪ বছরের হিসাব হস্তান্তর করতে চেয়ে ছিলেন। আমরা সচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য ৬ সদস্য বিশিস্ট একটি অডিট কমিটি গঠন করে তদন্ত করাচ্ছি। তবে তাকে কিভাবে চাপ দিলাম। আসমার আত্নহত্যার জন্য তার স্বামী (ফজলুর) দায়ী। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আসল রহসৎ বেরিয়ে আসবে। আর সে (ফজলুর) নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা-বানোয়াট মামলা করেছে। এছাড়া একটি পক্ষ তাকে ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করছে। তাছাড়া শুনেছি পারিবারিক কলহের কারণে ইতিপূর্বে আরো দু’বার আত্নহত্যার চেষ্টা করেছে আসমা।এব্যাপারে গ্রেফতারকৃত আনোয়ার মিয়ার স্ত্রী সুরমা আক্তার শিবলী বলেন, আমার স্বামী উনার (আসমা) সাথে খারাপ আচরণ করলে কি আর স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনি (আসমা) আমাদের বাড়িতে দাওয়াতে (৩ জুলাই) আসতেন। পারিবারিক কলহের জের ধরেই আসমা আত্নহত্যা করেছেন। আর তার স্বামী নিজেকে বাঁচাতেই স্কুল কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। শুনেছি পারিবারিক কলহের কারণে ইতিপূর্বে আরো দু’বার আত্নহত্যার চেষ্টা করেছেন আসমা।বিশ্বনাথ থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) শামীম মুসা বলেন, বিষয়টি নিয়ে পুলিশী তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। আর সুষ্ট তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হবে। এঘটনায় কাউকে হয়রাণী করা হবে না। এব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ কামরুজামান ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সমীর কান্তি দেব বলেন, প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য কর্তৃক অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলাকে অবৈধভাবে হিসাব দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে তার (আসমা) মৃত্যুর পূর্বে কেউ কোন অভিযোগ করেননি, এমনকি অবহিতও করেননি।