আমার সহপাঠি ও বাল্য বন্ধু নবাব আলী। সেসময়ে পাবনা শহরের ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত পাবনা রাধানগর মজুমদার একাডেমি বা আরএম একাডেমিতে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণি হতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এক সঙ্গে লেখাপড়া করেছিলাম। তখন তার সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ছিলো। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাশ করার পর আমি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হলাম, নবাব পড়া-লেখা বাদ দিয়ে তার বাবার হোটেলে ম্যানেজারি শুরু করলো। প্রথম দিকে আমি ওর হোটেলে যেতাম, বোর্ডার না থাকলে উপর তলার আবাসিকে বসে সময় কাটাতাম। দেখা করতে গেলেই ও আমাকে খাওয়াতো। কিন্তু ওর খাওয়ানোর পরিমাণ এতই বেশি ছিলো যে, হেটেলের বয়-মেসিয়াররা মনে করতো আমি বোধ হয় মাংগনা খাবার জন্যই সেখানে যাই। আমার মধ্যে এমন ভাবের উদয় হওয়ায় আমি আর সেদিকে যেতাম না। আস্তে আস্তে আমাদের বন্ধুত্বেও ভাটা পড়ে। কথায় বলে ‘আসতে যেতে মানুষের কুটুম, আর চাটতে-চুটতে গরুর কুটুম।’ আমাদের ও যেন তাই। তবুও অনেক দিন পর পর দেখা হতো। একবার জানলাম ওর বাবা মারা গেছে। ভাই-বোনদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারায় ও হোটেলটি তার ভাগে পেয়েছে।
১৯৮২ সালের শেষ দিকে দীর্ঘদিন পর তার সাথে আমার আবার দেখা। জিজ্ঞাসা করলাম। তুই কেমন আছিস নবাব? নবাব একটি দীর্ঘশ^াস ফেলে বল্লো, আর বলিসনে ভাই, ছোট বেলা বাবা মা আদর করে নাম রেখেছিলা নবাব, আর এখন খেতে না পেয়ে শুকিয়ে হয়ে যাচ্ছি কাবাব। জিজ্ঞাসা করলাম তার মানে? মানে এই কিছুদিন হলো আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি কৌতুহলি হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম সর্বনাশ মানে? সে বল্লো বর্তমানে এরশাদ সরকার গ্রামের মধ্যে সব কোর্ট-কাছারি অফিস-আদালত নিয়ে যাবার ফলে আমাদের হোটেল ব্যবসা লাঠে উঠেছে। তুই তো জানিস উপর তলায় আবাসিক আর নিচ তলায় হোটেল চলছিলো। আয় রোজগার বেশ ভালই হতো। কিন্তু এরশাদ ক্ষমতায় আশার পর থেকে তার মাথায় পোকা ঢুকেছে। প্রত্যেক উপজেলায় কোর্ট বসাবে। জজ, ম্যাষ্টেট সাহেবদেরকে গ্রামের পাঁক-কাদার মধ্যে নিয়ে যাবে। তা নিক কিন্তু আমাদের পাছার কাপড় যে খুলে যাচ্ছে। হেটেলে কোন বোর্ডার নেই আসেওনা। খাবারের জন্য আগে ঝাঁক ধরে এসে খাবার খেতো। বিশ^াস কর দোস্ত একটা মাছিও আর আসেনা।
তদানিন্তন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ( এইচ এম এরশাদ)ক্ষমতা গ্রহণের পর হতেই শাসনযন্ত্রে বিকেন্দ্রিকরণ শুরু করেন। তিনি দেশের ৪২টি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করেন এবং প্রতিটি থানা পরিষদকে উপজেলা পরিষদে রুপান্তর করেন। প্রতিটি উপজেলায় তিনি টিএনও নিযুক্ত করেন এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন। প্রতিটি উপজেলায় দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালত বসান। বিচারক, আইনজীবী, আইনজীবী সহকারিসহ সংশ্লিষ্টরা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পা বাড়ান। , এইচএম এরশাদ ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাস হতে পরবর্তী ’৮৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ৪৬০টি উপজেলা পরিষদ সৃষ্টি করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করেন। মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটতে থাকে। শহর এলাকা রাতারাতি যেন শ্মশানে পরিণত হয়।
যেমনটি বর্তমান করোনকালে হতে চলেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের বাসা-বাড়ির অবস্থা । করোনাভাইরাসে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পবির্তন ঘটার কারণে মানুষ ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে। ফলে ঢাকার ফ্লাট বাসা-বাড়ির মালিকেরা নিদারুন অসহায়ত্বের মাঝে পড়েছে। ঘাতক ব্যাধি করোনাভাইরাসের আক্রমণের প্রথম দিকে ভাড়াটিয়াদের কারো সামান্য স্বর্দি-কাশি জ¦র ইত্যাদির লক্ষণ দেখা দিলে করোনাতঙ্কে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াকে বাসা-বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার জন্য চাপ সৃষ্টি করতো। বিশেষ করে সাংবাদিক, চিকিতসক, নার্স, আয়াসহ চিকিতসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরকে তারা বাসা-বাড়িতে ঠাঁই দিতেই চাইতোনা।
কিন্তু গাড়ির চাকা হঠাৎ করেই ঘুরে গেলো। দেখতে দেখতে মানুষজন গরিব হতে শুরু করলো। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ সময় লকডাউনে পড়ে অনেকেরে ব্যবসা লাটে ওঠে। অনেকে চাকরি হারায়। অনেকে পেশা বদল করেও ঢাকা শহরের ভাড়া বাসায় থেকে কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছেনা। ফলে পরিবারের সদস্যদেরকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে ‘যাঁহা রাত- তাঁহা কাত’ এর মত দিনগুজরান করছে। অনেকে আবর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে পরিবার পরিজন নিয়ে চিরতরে ঢাকা ছাড়ছেন। ফলে ভাড়াটিয়ার অভাবে বাড়িওয়ালাদের এখন নাভিম্বাস উঠতে শুরু করেছে।
এক পরিসংখ্যান হতে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় মেস বাসা রয়েছে প্রায় ১৫ লাখ, যার প্রতি কক্ষে বাস করেন ৫ থেকে ৮ জন। ভাড়া মাথাপিছু ৩ হাজর থেকে ১৪ হাজার। কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভাড়া থাকেন প্রায় ২০ লাখ। সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজে যুক্ত এমন ব্যাচেলর প্রায় ১০ লাখ। গার্মেন্টস কর্মি ব্যাচেলর ৫ থেকে ৭ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। তাই ইতোমধ্যেই ভাড়াটিয়া হারিয়ে রাজধানী ঢাকা শহরের প্রায় আড়াই লাখ বাড়িওয়ালা দারুন বিপাকে পড়েছে। দেশে উদ্ভূত করোনা পরিস্থিতিতে মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। এতে বিপাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাড়িওয়ালারা। মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী ও মাঝারি বব্যবসায়ীরা তাদের সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থে অল্প পরিমাণ জায়গা কিনে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। কারো কারো ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে। অনেকেই পারিবারিক সুত্রে জায়গার মালিক হয়ে বাড়িওয়ালা হয়েছেন। ভাড়াটিয়া চলে যাবার কারণে তাদের অবস্থা আমার বাল্যবন্ধু নবাব আলীর মত হতে বসেছে।
ঢাকায় ভাড়াটিয়াদের াধিকার নিয়ে কাজ করা ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, ‘ ঢাকা শহরে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ লোক ভাড়া থাকে। এদের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত এবং প্রায় ৪ লাখের অধিক বাড়িওয়ালার মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার বাড়ির মালিক ও মধ্যবিত্ত।
ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২ হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক মে মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোকের চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। আর দৈনিক মজুর্ িভিত্তিতে যারা কাজ করেন, তাদের ৬২ শতাংশই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ১০ টি জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ শাতাংশ। পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে রাজধানীর বাসিন্দাদের ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। যাদের মধ্যে অনেকেই এখন হারিয়েছেন চাকরি, উপার্জনের পথ। মোদ্দা কথা করোনার কারণে আয়ে যে ধাক্কা লেগেছে , সেটা সামাল দিতে না পেরে নগরে আসা লোকজনকে ফিরে যেতে হচ্ছে নিজ নিজ গ্রামে, নিজ নিজ শিকড়ে। (সুত্র: জাগো নিউজ)। )। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।