আমরা সকলে আল্লাহ তায়ালার সুনিপুণ সৃষ্টি। এক প্রাণ থেকে এক অদ্বিতীয় আল্লাহ তায়ালাই আমাদের সৃষ্টিকর্ম সম্পাদন করেছেন। অতঃপর চারিদিক বিস্তৃত করেছেন আমাদের বংশ পরিক্রমাও। যার ফলে সারা পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানবজাতির অস্তিত্ব। মানুষের ধর্ম, বর্ণ, গন্তব্য পৃথক পৃথক হলেও সকলে যে একই প্রাণ থেকে উদ্ভুত, পবিত্র কুরআন একথার অবলীলায় স্বীকৃতি দিয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘হে মানবজাতি, তোমাদের রবকে ভয় কর। যিনি তোমাদের এক প্রাণ হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা হতে সৃষ্টি করছেন তারই স্ত্রীকে। অতঃপর উভয় থেকে অসংখ্য পুরুষ এবং নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন’ (সূরা নিসা, আয়াত:১)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে: ‘হে মানবজাতি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের নানান দল, উপদলে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা জানতে পার, আল্লাহর নিকট অধিক তাকওয়াবান ব্যক্তিই সর্বোচ্চ সম্মানিত। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক সর্বজ্ঞানী, সর্ববিষয়ে খবর রাখেন’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩)।
মানুষে মানুষে এই মৌলিক সম্পর্কের কথা ভেবে ইসলাম তার গণ্ডিতে বর্ণ বৈষম্যের জন্য কোনো স্থান রাখেনি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় ভাষায় কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন এই জাতিবিদ্বেষ ও বর্ণবৈষম্যকে। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছিলেন: ‘‘হে মানবজাতি, জেনে রেখ, নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু একজন। তোমাদের পিতাও একজনই। জেনে রেখ, অনারব ব্যক্তির উপর কোনো আরবির শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আর কোনো আরবির উপর অনারবিরও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কৃষ্ণাঙ্গের উপর রক্তিম ব্যক্তির কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আর রক্তবর্ণের উপরও কৃষ্ণাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই; সমস্ত শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে’ (মুসনাদে আহমদ)। তিনি আরো বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই এদিনটি হারাম হওয়ার ন্যায় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পরস্পরের জন্য পরস্পরের রক্ত, সম্পদ এবং সম্মানে (অন্যায়ভাবে) হাত দেয়াকেও হারাম করেছেন’’ (মুসনাদে আহমদ)।
আজকের আধুনিক পৃথিবীতে দেখা যায়, সবাই উল্টো পথে হেটে চলেছে। বিশেষকরে আধুনিক বিশ্বের রিমোট কন্ট্রোল যেসব দেশের হাতে, তারাই এখন জাতিবিদ্বেষ ও বর্ণবাদী চেতনার চাষাবাদ করে মানবতার গায়ে হরহামেশা কালিমা লেপন করে যাচ্ছে। অথচ আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অদ্য হতে চোদ্দ শতাধিক বছর পূর্বে এই বর্ণবাদের অভিশাপ থেকে মানবজাতির মুক্তির কথা বলে গেছেন।
ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে, এ ধর্মটি ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। এতে হিংসা, বিদ্বেষ, পরনিন্দা, ধোঁকাবাজি, দলাদলির কোনো স্থান নেই। মুসলিম মাত্রই ভাই-ভাই বিবেচনা করতে শিখিয়েছেন আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সেই শিক্ষা পবিত্র কুরআন মাজীদে এভাবে উল্লিখিত হয়েছে– ‘মুমিনরা মাত্রই ভাই-ভাই। অতঃপর তোমাদের ভাইদের মাঝে সন্ধিস্থাপন করে দাও। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১০)। এ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন এই ধর্মের ভিত্তি মজবুত থাকবে। আল্লাহর রহমতের অবারিত ঝর্ণাধারা বহমান থাকবে। বিপরীতে বিভেদ, শত্রুতা যখন বেড়ে যাবে, তখনই নড়বড়ে হয়ে যায় এর ভিত্তি।
এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়ই ভ্রাতৃত্বের দোয়া করতেন। নামাযের পরপরই তিনি এ দোয়াটি প্রায়ই পাঠ করতেন– ‘আমাদের ও সকলের প্রভু, হে আল্লাহ তায়ালা! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনিই এক প্রভু। আপনার কোনো শরীক নেই। আমাদের ও সকলের প্রভু, হে আল্লাহ তায়ালা! আমি এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ আপনার বান্দা ও রাসূল। আমাদের ও সকলের প্রভু, হে আল্লাহ তায়ালা! আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, সকল বান্দাই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ’ (আবু দাউদ থেকে সংক্ষেপিত)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আরবসমাজে আবির্ভূত হন, তখন পুরো আরব সমাজই অন্যায়-অনাচার, পাপাচারের কালিমায় কলুষিত ছিল। সমাজের উচ্চপদস্থ অধিপতিরা বড়বড় অপরাধ করেও দিব্যি নিষ্পাপের ন্যায় ঘুরে বেড়াত। আর দূর্বল, অসহায় শ্রেণী বিন্দুমাত্র অপরাধ করলেই তাদের দিকে দ্রুতই ধেয়ে আসত বহুমুখী শাস্তির তুফান। এভাবে তারা যখন জলুম, নির্যাতনে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তখনই আরব সমাজে ইসলামের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ন্যায়ের দৃষ্টান্ত এমন যে তিনি নিজেই ইরশাদ করলেন: ‘তোমাদের পূর্ববর্তীরা ধ্বংস হয়েছে কেবলমাত্র একারণে যে, নেতৃস্থানীয়রা চুরি করলে তারা ছেড়ে দিত, আর দূর্বলরা চুরি করলে শাস্তি কায়েম করত। আল্লাহর শপথ, (আমি) মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করত, আমি তারও হাত কেটে নিতাম’ (বুখারি ও মুসলিম)।
সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এ দৃষ্টান্ত যে শুধুই মুসলমানদের জন্য, তা নয়। তিনি অভূতপূর্ব ন্যায়ের উদাহরণ রেখে গেছেন বিধর্মীদের ক্ষেত্রেও। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘সাবধান, যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের প্রতি জুলুম করবে, অথবা তার অধিকার বিনষ্ট করবে, অথবা তার সাধ্যের বাইরে কিছু চাপিয়ে দেবে, অথবা অন্যায়ভাবে তার নিকট থেকে কিছু আত্মসাৎ করবে। আমি কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াব’ (আবু দাউদ)।
এজন্য মুমিন বলা হয় তাকে, যার কাছ থেকে সারা পৃথিবীর নিরাপরাধ মানুষ নিরাপদ থাকে। একথাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই অন্য এক হাদিসে বলেছেন: ‘প্রকৃত মুমিন সেই ব্যক্তি, যার হাত থেকে মানুষের সম্পদ ও সম্মান নিরাপদ থাকে’ (মুসনাদে আহমদ)।
কেউ-কেউ বলে থাকেন, ইসলাম কিনা তলোয়ার মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছে। তাদের একথা সঠিক নয়। কেননা ইসলাম অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধেই কেবল তলোয়ার উত্তোলন করেছে। বাস্তবতা হলো, ইসলাম প্রসারিত হয়েছেই শুধুমাত্র মায়া-মমতা, উদারতা ও মানবতার হাত ধরে। মক্কাবিজয়সহ অসংখ্য ঘটনা তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট করে দেয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ এই হাদিসটি তুলে ধরা হলো: ‘নবুওয়ত প্রকাশের পূর্বের ঘটনা। একদা এক ব্যক্তি মক্কায় আগমন করল। ইতিপূর্বে নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সংবাদ পাওয়ায় লোকটি সবার নিকট নবিজি সম্পর্কে জানতে চাইছিল। যখন রাসূলুল্লাহর সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ হল, তখন সে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে? নবীজি বললেন: আমি আল্লাহর রাসূল। আবার জিজ্ঞেস করল, কে প্রেরণ করেছেন আপনাকে? তিনি বললেন: আল্লাহ তায়ালা। তারপর জিজ্ঞেস করল, কী দায়িত্ব অর্পণ করে আপনাকে প্রেরণ করেছেন? অতঃপর নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে, রক্ত সংরক্ষণ করতে, রাস্তাসমূহ নিরাপদ রাখতে, মূর্তিসমূহ উৎখাত করতে। আর এক আল্লাহর ইবাদত করে তার সাথে কোনো কিছু শরীক না করতে’ (মুসনাদে আহমদ)।
এই ঘটনায় রাসূলুল্লাহর দাওয়াতি পদ্ধতি থেকে আমরা পাই, দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পূর্বে তিনি ঐ ব্যক্তিকে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা, রক্ত-সংরক্ষণ তথা রক্তপাত বন্ধ করা এবং রাস্তাসমূহের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নিজ আগমনের কথা অবহিত করেছেন। অর্থাৎ আগে মানবতার গান শুনিয়েছেন, তারপর শুনিয়েছেন ধর্মের বাণী। এভাবে দ্বারা তিনি এই সমাজে মানবতা প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে নিজ ধর্মের গুরুত্ব উপস্থাপন করেছেন। কেননা সেকালের আরবসমাজে উপরোক্ত দায়িত্ব তিনটিই পালনের অভাব ছিল। বর্বর আরব সমাজে তখন সম্পর্কের কোনো বালাই ছিল না; বাবা মারা যাবার পর সন্তান তার মাকে বিয়ে পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করত না, এছাড়া নারীরা ছিল খেলনার পুতুল। তাই প্রয়োজন হয়েছিল এই পাপাচার, অনাচার রোধ করার। রক্তসংরক্ষণ তো স্বপ্নই ছিল তাদের জন্য; প্রত্যহ যুদ্ধবিগ্রহ, মারামারি, খুনাখুনি, রক্তপাতের নেশা তাদের গ্রাস করে বসেছিল। তাই প্রয়োজন ছিল রক্তপাত বন্ধ করার।
আর রাস্তাঘাট ছিল অনিরাপদ। ব্যবসা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার; যেকোনো মুহূর্তে মানুষ হত লুণ্ঠন, হামলা, ধাওয়ার শিকার। এই অপরাধও বন্ধের দাবি জেগে উঠছিল জনমনে। সবার প্রতীক্ষা তখন সেই মহামানবের, যার হাত ধরে দূরীভূত হবে হবে এসকল অনাচার, অপরাধ। তাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াত দেয়ার পূর্বে ঐ ব্যক্তিকে জানিয়ে দিলেন সেই প্রতীক্ষিত মহামানবরূপে আবির্ভূত হবার কথা। এরপর যতই তিনি অনাচার দূরীভূতকরণে অগ্রগামী হয়েছেন, ইসলাম ততই প্রসারিত হয়েছে। মানুষ সাড়া দিয়ে দলে দলে আশ্রয় নিয়েছে ইসলামের ছায়াতলে।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিম-অমুসলিম সকলের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানো ইসলাম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র শিক্ষার অন্যতম। তাই বর্তমান করোনা ভাইরাসের প্রকোপে উদ্ভুত এই সংকটকালীন পরিস্থিতিতে মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে সকল মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের একান্ত কর্তব্য।