সভ্যতা। ক্ষয়িষ্ণুতা যেমন তার ইতিহাস, তেমনি এর উত্থান-পতনও দৃশ্যমান। আজকের এ সুন্দর বসুধা, মানবসভ্যতা, দেশ-বিদেশের আকাশচুম্বী অট্টালিকা, পরিপাটী পরিবেশ-সবগুলোর পেছনে কারো না কারো দৃশ্য-আদৃশ্য হাত আছেই। শ্রমনির্ভর এসব কর্মযজ্ঞ যাঁদের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মার্জিত ও শিষ্ট, তাঁদের অবদান ঐতিহ্যের স্মারক লিপিবদ্ধ। তাঁরাই সভ্যতার কারিগর। এ সুন্দর শ্যামল পৃথিবী বসবাসযোগ্যকারী। তাঁদের আছে ইসলামে বিরাট অবস্থান। তাঁদের প্রতি সম্মান, প্রাপ্য আদায় সহ তাঁদের অবদান স্বীকৃতিতে ইসলাম কখনো কার্পণ্য দেখায় নি।
শ্রম দিয়ে, মেহনত করে, গতর খেটে যারা জীবিকা জোগাড় করে তাদের বলা হয় শ্রমিক বা মেহনতি মানুষ। ইসলাম এদের মর্যাদা প্রাথমিককাল থেকেই দিয়ে আসছে। শ্রম দ্বারা যে মানুষ হালাল জীবিকা উপার্জন করে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ভূষিত করেছেন আল্লাহর বন্ধু উপাধিতে।
যে কোনো পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি শ্রম প্রদান করে শ্রমিক। তাই ইসলাম শ্রমিকদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের কাজের গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম।
আল্লাহ তা‘আলা কাজের জন্য মানুষকে নামাজে পর বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “অতপর তোমরা নামাজ শেষ করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়। আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করো এবং বেশি পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করো, যাতে সফলকাম হতে পার।” [আল-কুরআন, সূরা জুমু‘আ, আয়াত : ১০]।
শ্রমিকই হলো সকল উন্নয়ন ও উৎপাদনের চাবিকাঠি। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি উন্নত। শ্রম আল্লাহ প্রদত্ত মানব জাতির জন্য এক অমূল্য শক্তি ও সম্পদ। এ সম্পর্কে আল কুরআনের বাণী, “নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করেছি।” [আল-কুরআন, সূরা বালাদ, আয়াত : ৪।]
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা, কাজ ও উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে শ্রম ও শ্রমিকদের প্রশংসা করেন। শ্রমকে ভালোবাসতেন স্বয়ং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও। নিজ হাতে জুতা মুবারক মেরামত করেছেন, কাপড়ে তালি লাগিয়েছেন, মাঠে মেষ পালন করেছেন। পরিচালনা করেছেন ব্যবসাও। খন্দকের যুদ্ধে নিজ হাতে পরিখা খনন করেছেন। বাড়িতে আগত মুসাফির কর্তৃক বিছানায় ত্যাগকৃত মলযুক্ত কাপড় ধৌত করে মানবতা ও শ্রমের মর্যাদা সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। সায়্যিদুনা হযরত মিকদাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “কোনো ব্যক্তি তা থেকে উত্তম আহার করেনি, যা সে নিজ হাতে উপার্জন করে খেয়েছে। আল্লাহর নবী দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন।” [সহিহ বুখারি, খ.১, পৃ.২৭৮, হাদিস নং-২০২৫।]
নবীজির (সা.) অন্যতম সাহাবি হযরত সা‘দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কামারের কাজ করতেন, হাতুড়ি দিয়ে কাজ করতে করতে তাঁর হাত দুটি বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। একদিন নবীজি (সা.) এর সাথে করমর্দন করার সময় সা‘দকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, হাতুড়ি দিয়ে কাজ করতে গিয়ে এ অবস্থা হয়েছে। নবী করীম (সা.) তাঁর হাত চুম্বন করে বললেন, “এ হাতকে কখনো আগুন স্পর্শ করবে না।” [সহিহুল বুখারি, পৃ. ৪।]
শ্রমজীবী মানুষ এবং অধীনস্ত কর্মচারীর মর্যাদা ঘোষণায় ইসলাম দিয়েছে অনন্যতার পরিচয়। আল্লাহ তা‘আলা শ্রমকে নিআমতের সাথে তুলনা করে বলেন, “যাতে তারা তার ফল আহার করে এবং তাদের হাত যা কাজ করে তা হতে; তারা কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না?” [আল-কুরআন, সূরা ইয়াসিন, আয়াত : ৩৫।] শ্রমিকদের যেন মানুষ ঘৃণা না করে বরং তাদের সম্মানের চোখে দেখে সে ব্যবস্থা করেছে ইসলাম। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো পেশাই ঘৃণিত নয়। রসুলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেটে খাওয়া মানুষের মর্যাদা বর্ণনা করে ঘোষণা করেন, আল-কাসিবু হাবীবুল্লাহ অর্থাৎ, শ্রমিক আল্লাহর বন্ধু [কানযুল উম্মাল, খ. ৪র্থ, পৃ. ১২৭]। ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তির চেয়ে শ্রমিকদের মর্যাদা অধিক হিসেবে বর্ণনা করেছে।
রসুল (সা.) ঘোষণা করেন, “ঐ সত্ত্বার শপথ! যাঁর হাতে আমার জীবন! তোমাদের কারও পক্ষে একগাছা রশি নিয়ে বের হওয়া এবং কাষ্ঠ সংগ্রহ করে পিঠে বোঝাই করে বয়ে এনে কোনো লোকের কাছে গিয়ে ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে উত্তম। অথচ সে ব্যক্তি তাকে দান করতেও পারে অথবা তাকে বিমুখও করতে পারে।” [সহিহুল বুখারি, খ. ১, পৃ. ১৯৯, হাদিস নং-১৪৪৯, ১৪৫০, ১৪৫৮।]
ইসলামে শ্রমের মর্যাদা যেমন দেয়া হয়েছে তেমনি শ্রমিকেরও মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম নিজে কৃষি কাজ করে জমিতে ফল-ফসল উৎপাদন করে সংসার নির্বাহ করতেন, জীবিকা সংগ্রহ করতেন। তিনি এবং মানবজাতির আদি মাতা হযরত হাওয়া আলাইহাস সালাম কাপড় বুনন, সেলাই, কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি প্রভৃতি নিজেদের শ্রমের দ্বারাই করতেন। কুরআন মজিদে বেশ কয়েকজন নবীর কায়িক শ্রমের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহর নবী হযরত নূহ আলাইহিস সালাম মহাপ্লাবনের পূর্বে আল্লাহর নির্দেশে এক বিশাল কিস্তি নিজ শ্রমের মাধ্যমে নির্মাণ করেছিলেন। কাঠ দিয়ে গড়া এই বিশাল কিস্তি নির্মাণে তিনি যে কাঠ ব্যবহার করেছিলেন সেই কাঠ ছিল তাঁর নিজ হাতে লাগানো গাছের। তিনতলা ও বহু কক্ষবিশিষ্ট এই কিস্তি যখন তিনি কাঠ কেটে, হাতুড়ি পিটিয়ে নির্মাণকার্যে ব্যস্ত ছিলেন তখন তা দেখে তাঁর লোকজন তাঁকে সূত্রধর বলে দারুণ ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছিল এবং গালিগালাজও করেছিল। মহান রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা- তিনি [নুহ আলাইহিস সালাম] কিস্তি নির্মাণ করতে লাগলেন এবং তাঁর সম্প্রদায়ের প্রধানেরা তাঁর নিকট দিয়ে যাত্রাকালে তাঁকে উপহাস করতো, তিনি বলতেন, তোমরা যদি আমাকে উপহাস করো তবে আমরাও তোমাদেরকে উপহাস করবো, যেমন উপহাস তোমরা করছো। [আল-কুরআন, সূরা হূদ, আয়াত : ৩৮।]
হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে লোহা দ্বারা বর্ম তৈরি করতেন এবং তা বিক্রি করে যা আয় করতেন তা দিয়ে সংসার চালাতেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমি তাঁর [দাউদ আলাইহিস সালাম] জন্য লৌহকে নমনীয় করে দিয়ে ছিলাম।’ [আল-কুরআন, সূরা সাবা, আয়াত : ১০।] এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হযরত দাউদ আলায়হিস্ সালাম একজন দক্ষ কর্মকার ছিলেন। এই হযরত দাউদ ‘আলায়হিস সালামের নিকটই নাজিল হয়েছিল আসমানি কিতাব যবুর। তিনি এক বিশাল রাজ্যের বাদশাহী লাভ করেছিলেন এবং তাঁরই পুত্র ছিলেন হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম। ইসলামে আ‘মালুস সালেহ বা সৎকর্ম বলতে যে সমস্ত কাজের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে হালাল রুজির জন্য পরিশ্রম করাটাও রয়েছে। ইসলাম আল্লাহর দেয়া প্রগতিশীল পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে যেমন পার্থিব জীবনের সত্যিকার কল্যাণের দিকনির্দেশনা রয়েছে তেমনি রয়েছে আখিরাতে কল্যাণ লাভের নির্দেশনাও।
ইসলাম শ্রমিকদের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে, এ জন্য ইসলাম সুনির্দিষ্ট কাঠামো নির্ধারণ করেছে, যার সাহায্যে আমরা অতি সহজেই একটি ন্যায়নুগ শ্রমনীতি নির্ধারণ করতে পারি। শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্য ও সম্মানজনক মজুরি দেওয়ার নির্দেশও ইসলামে রয়েছে। শ্রমিকের মজুরি এমনভাবে নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে যাতে সে মালিকের মতো পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে। খেয়েপড়ে সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা-সমানভাবে পেতে পারে। ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না’ এই অসমনীতি ইসলাম সমর্থন করে না। শ্রমিকেরা কঠিন পরিশ্রম করে, দেহের ঘাম ঝরিয়ে উৎপাদন করবে আর সেই উৎপাদন থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে মালিক বিলাসবহুল জীবনযাপন করবে- এটা ইসলাম চায় না। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার ন্যায্য মজুরি দিয়ে দাও’। [ সুনানু ইবন মাযাহ পৃ. ২৫৯।]
আজকের এ সমাজে ইসলাম শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে নির্দেশনামা প্রদান করেছে, যদি আমরা সেদিকে দৃষ্টি প্রদান করি তাহলে সত্যিকারে একজন শ্রমিক সমাজে যুগান্তকারী সফলতা লাভ করবে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সুসমৃদ্ধ হবে আমাদের জীবনযাত্রার অগ্রগতিও। বিশিষ্ট সাহাবিয়ে রসুল (সা.) হযরত মিকদাম ইবন মাযদি কুরায়ব আয-যুবাইদি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি নবী কারীম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, “মানুষের নিকট তার চেয়ে কোনো উত্তম উপার্জন নেই, যা সে নিজের হাতে উপার্জন করে খায়। সে যা কিছু নিজের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য ও ঘরের ভৃত্যদের জন্য খরচ করে তা সবই সদকা।” [সহিহুল বুখারি, খ.১, পৃ. ১৯২।]
মহানবী (সা.) নিজেই ভৃত্য, কর্মচারীদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখতেন এবং রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতেন। মহানবীর আদর্শ হলো শ্রমিককে দিয়ে এমন কিছু করানো যাবে না, যার ফলে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে এবং তার লোকসান হয়। ইসলামের শ্রম আইনের দৃষ্টিতে বৃদ্ধ, পঙ্গু, অসুস্থ, অসহায়, এতিম, বিধবা এবং দুর্বলদের ভরণ-পোষণ ও তাদের যাবতীয় দায়িত্বভার রাষ্ট্রের। সরকার রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় কোষাগার থেকে তাদের সমস্ত প্রয়োজন পূরণে ভাতা নির্ধারণ করবে। মহানবী (সা.) এর শাসনামলে এর চরম নিদর্শন দেখা যায়। আধুনিক রাষ্ট্রে শ্রমিকের নিজের ও তার পরিবারের শিক্ষার দিকে নজর দেয়া হয় না। অথচ মহানবী (সা.) এর নীতি হলো শিক্ষা হবে অবৈতনিক। যার ফলে সকল ব্যয়ভার রাষ্ট্রই বহন করবে।
ইসলামে জ্ঞান অর্জন করা নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে ফরজ। হযরত ওজলী ইবনে আতা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা মতে, “মদিনায় তিনজন শিক্ষিত মুসলমান ছিলেন, তাঁরা মদিনার শিশুদেরকে শিক্ষা দিতেন। আর হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁদেরকে রাষ্ট্রীয় তহবিল (বায়তুল মাল) থেকে মাসোহারা (বেতন) দিতেন।” শ্রমিকদের অধিকার মালিকরা ঠিকমত আদায় করছে কিনা সেদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নজর রাখার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে অর্ধজাহানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী খলিফা হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।
খেটে খায় বলে শ্রমিককে অবমূল্যায়ন, তাঁদের প্রতি অন্যায় এবং যথাসময় প্রাপ্য আদায়ে গড়িমসি ইসলাম কস্মিনকালেও সমর্থন করে না। এমনকি শ্রমিকের শ্রমসিক্ত ঘর্মাক্ত শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তাঁর পারিশ্রমিক প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। আজকের এ সমাজে ইসলাম শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে নির্দেশনামা প্রদান করেছে, যদি আমরা সেদিকে দৃষ্টি প্রদান করি তাহলে সত্যিকারে একজন শ্রমিক সমাজে যুগান্তকারী সফলতা লাভ করবে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সুসমৃদ্ধ হবে আমাদের জীবনযাত্রার অগ্রগতিও।