উজানের পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় লালমনিরহাটে সৃষ্ট বন্যায় প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রোববার দুপুর ১২টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। যা স্বাভাবিকের (৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) চেয়ে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫/২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে তিস্তার বাম তীরের লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলার প্রায় ১০ হাজার পরিবার টানা চার দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, উজানের পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত সপ্তাহের শেষ দিকে টানা ২৪ ঘণ্টা বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তিস্তা নদী। ফলে নিম্নাঞ্চলে বন্যার সৃস্টি হয়। যা কমে গিয়ে বন্যার উন্নতি ঘটে। এর রেশ কাটতে না কাটতে বৃহস্পতিবার উজানের ঢল ও ভারী বর্ষণের কারণে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ব্যারেজ রক্ষার্থে সব জলকপাট খুলে দিয়ে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছেন ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ। যা টানা চার দিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। ফলে জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা, ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
টানা চার দিন পানিবন্দি পরিবারগুলোর কেউ কেউ পাশের নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে আবার কেউ রাস্তা বা বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ ঘরে খাট চৌকি দিয়ে মাচাং বানিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। চরম বিপাকে পড়েছেন বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী আর শিশুরা। তিস্তা চরাঞ্চলের প্রতিটি গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এসব চরাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে গরু, ছাগলসহ বিভিন্ন গৃহপালিত পশু-পাখি। এসব গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার কৃষকরা। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে শত শত পুকুরের মাছ।
অব্যাহত বন্যায় ডুবে গেছে উঠতি ফসল বাদাম, ভুট্টাসহ নানান জাতের সবজি। ফসল নষ্ট হওয়ায় নিদারুন অর্থ কষ্টে পড়েছেন এসব অঞ্চলের চাষিরা। আসন্ন ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে অনেকেই ঘরে ঘরে গরু ছাগল মোটাতাজা করেছেন। কিন্তু বন্যার পানিতে খাদ্যসংকটে স্বাস্থ্যহানী হচ্ছে এসব মোটাতাজা গরুর। ফলে লোকসানের শঙ্কা খামারিদের।
অব্যাহত বন্যার কারণে রান্না করতে না পেরে অনেকেই এক বেলা খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। এসব এলাকায় শুকনো খাবার ও শিশু খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
বন্যার সঙ্গে নদী ভাঙন যুক্ত হওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিস্তা বামতীরের মানুষ। শনিবার ২৪ ঘণ্টায় সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা গ্রামে ২৫টি বাড়ি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে পড়েছেন বামতীরের কয়েক হাজার মানুষ। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে তিস্তা পাড়ের এসব মানুষ। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে অধিকাংশ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। যা দীর্ঘদিন ধরে মেরামতের দাবি জানিয়ে আসছেন স্থানীয়রা। কিন্তু তা সংস্কারে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
হাতীবান্ধার গড্ডিমারী এলাকার আবুল হোসেন বলেন, চার দিন ধরে বন্যায় ডুবে আছি। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। ঘরের ভেতর খাট ও চৌকিতে মাচাং বানিয়ে দিনে রান্না করে তাই রাত পর্যন্ত খেয়ে কোনো রকম বেঁচে আছি। করোনার কারণে আত্মীয়ের বাড়িতেও পাঠাতে পারছি না।
আদিতমারীর গোবর্দ্ধন পাসাইটারী গ্রামের বাবুল বলেন, চারদিকে পানি পরিবার নিয়ে শুকনো স্থানে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। উঁচু রাস্তায় দাঁড়ালেও বৃষ্টির কারণে থাকার উপায় নেই। গরু ছাগল নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি।
লালমনিরহাট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলী হায়দার বলেন, পানিবন্দি ৮ হাজার পরিবারের জন্য ৬৮.৬৬ মেট্রিকটন জিআর চাল এবং ৬ লাখ ২৬ হাজার ২শ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৪১ পরিবারকে জনপ্রতি ২০ কেজি করে চাল ও ঘর মেরামত বাবদ নগদ ৭ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে।
দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি প্রবাহ বৃহস্পতিবার রাত থেকে বাড়তে থাকে। শুক্রবার সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সেই থেকে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। রোববার দিনভর বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি। ব্যারেজ রক্ষার্থে সবগুলো জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে।