ছয়-সাত যুগ আগের কথা। সেসময় না ছিলো রাস্তা-পথ, না ছিলো এখনকার মত যানবাহন। মহকুমা এবং জেলা শহর লাগোয়া কিছু পাকা সড়ক থাকলেও বাদবাকি সড়ক-পথ ছিলো কাঁচা এবং চলাচলের একেবারেই অযোগ্য। সেসময় গ্রাম থেকে মহকুমা শহর বা জেলা শহরে যাতায়াত করতে একমাত্র দুপায়ের ওপর ভরসা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা। শুকনো মৌসুমে ধুলা-বালি এবং বর্ষাকালে কর্দমাক্ত পথ চলতে দারুন দুর্ভোগ পোহালেও কারো কিছু বলার ছিলোনা। গ্রাম-গঞ্জের মেঠোপথ ধরে লোকজন তাই অবাধে চলাফেরা করতো। মাইলের পর মাইল পায়ে চলা পথ পাড়ি দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সমাধা করতো তারা।
গরু কিংবা মহিষের গাড়িই তখন তাদের যাতায়াতের এক মাত্র বাহন। গ্রামের মাঝখান দিয়ে একচিলতে ডহর বা গাড়ির নিরিখ ধরে গাড়োয়ানেরা গাড়ি নিয়ে যেতো। সৌখিন গাড়োয়ানেরা গরু-মহিষের গলায় ঘন্টা বেঁধে দিতো যা টুংটাং শব্দ করে ডহর মাতিয়ে চলতো। গৃহস্থলি জিনিষ-পত্র হাটে-বাজারে নিয়ে যেতো গাড়োয়ানেরা। হাসপাতালে রোগি বহন করতো তারাই।
এক কথায় বাঙ্গাল মুলুকের পুরো এলাকাটাই ছিলো গ্রাম। হাতে গোনা শহর, উপশহর। তবে নদী বন্দরের সংখ্যা ছিলো এখনকার তুলনায় অনেক বেশি। সেসময় গর্ভধারণকারি মায়েদের ছিলো যত জ¦ালা-যন্ত্রনা। এখনকার সকল যন্ত্রনা যোগ করলে সে তুলনায় নস্যি সমতুল্য। সন্তান সম্ভবা মায়ের প্রসব বেদনা উঠলে গ্রামের একমাত্র দাই বা ধাত্রি (চাওনি) ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ ও পন্থা খোলা ছিলোন। তারাই সন্তান প্রসবের মত জটিল কাজটি নির্দিধায় সমাধা করতেন। এখনকার মতো আলটাসনোগ্রামের মাধ্যমে ব্যাটা-বিটির আগাম চেহারা-ছুরত দর্শন কিংবা ভূমিষ্ঠের দিন-ক্ষণ কাঁটায় কাঁটায় বলে দিবার ব্যবস্থা তখন ছিলো অকল্পনীয়। তাই প্রসব বেদনা শুরুর কোন আগাম বার্তা জানা ছিলোনা। ছিলোনা সিজারিয়ানের মত কোন আধুনিক ব্যবস্থা। প্রসুতির ব্যাথা যখন শুরু হতো তখন তাকে গরু-মহিষের গাড়িতে করে সদরে নেওয়া সম্ভব হতোনা। তাতে গাড়ির ঝাঁকুনির ভয় ছিলো প্রবল।
চিরাচরিত প্রথানুসারে মায়েরা তাই নিজ বাড়িতেই সন্তান প্রসব করতেন। বাড়ির কর্তাব্যক্তি, মুরুব্বীগণ প্রসুতি মায়ের দিকে হর-হামেসা খেয়াল রাখতেন, যেন প্রসুতির কোন কষ্ট না হয়। সন্তান প্রসবের দিন কয়েক আগে থেকেই বাড়ির উঠানে, কিংবা বসত ঘরের এক কোনায় একটি নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত করা হতো। বাঁশের বাখারি কিংবা কঞি, তার সাথে উলু খড় বেঁধে গোলাকার কিংবা চারকোনাকার একটি ঘর নির্মাণ করা হতো প্রসুতি মায়ের জন্য। সেই ঘরের নাম ‘‘আঁতুড় ঘর’’। শীত কিংবা গ্রীষ্মকাল, ঝড়- বৃষ্টি- খরা যাই হোকনা কেন সন্তান প্রসব থেকে শুরু করে বেশ কিছু দিন যাবত মা এবং সদ্যজাত সন্তানকে বাধ্যতামূলকভাবে সেই আঁতুড় ঘরেই অবস্থান করতে হতো। সামাজিক নিয়মানুসারে আঁতর ঘরে কোন জানালা রাখা হতোনা। শুধু একটি মাত্র ছোট্ট দরজা, তাও আবার হামাগুড়ি দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হতো। গরমের হাত থেকে রক্ষার জন্য কাপড় কিংবা তালপাতা দ্বারা নির্মিত হাতপাখা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো। রাতের বেলা কুপি বাতি জ¦ালিয়ে রাখা হতো। যা সারারাত আঁতুড় ঘরকে আলোকিত করে রাখতো। কুপি বাতিটি বসানো থাকতো একটি কাঠের ‘গছা’র উপরে। ন্যাকড়ার পলিতা এবং মাছের তেল দ¦ারা কুপি বাতি জ¦ালানো হতো।
ছুত-ছ্যামা লাগার ভয়ে সেই ঘরের নিকটে কাউকেই যেতে দেওয়া হতোনা। সেজন্য ঘরের চারপাশ কাঁটাযুক্ত ডাল-পালা অথবা বেতের ডাল-পালা দিয়ে রাখা হতো। দাই বা ধাত্রী, কিংবা বাড়ির কোন দায়িত্বশীল মহিলাই কেবল যাতায়াত করতে পারতো। তখনকার দিনে প্রসুতি মায়ের জন্য আতুঁর ঘর ছিলো বাধ্যতামূলক। তাতে লাভ যা হতো, মা এবং সন্তান উভয়েই সুস্থ্য থাকতো। সাত দিনের দিন সাতের কামান দিয়ে মা এবং সন্তানকে সেখান থেকে বের করে আনা হতো। তবে আঁতুর ঘরে থাকাকালিন যদি কোন মা কিংবা সন্তানের কোন অসুখ বিসুখ হতো তাহলে তা সহজে ভালো হতোনা। আঁতুর ঘর থেকে সাতের কামানের পর বের হলেও আরেকটি কামান থাকতো তার নাম মাস্কে কামান। এই এক মাস অতি সাবধানে সন্তান ও সন্তানের মাকে রাখা হতো।
বর্তমান বৈশি^ক মহামারি করোনাভাই্রাসেরও একটি আঁতুড় ঘর রয়েছে। তা হলো চীন। চীন দেশের আঁতুড় ঘর থেকে উৎপত্তি হয়ে এই করোনাভাইরাস সারা বিশ^কে কাঁপিয়ে তুলেছে। পৃথিবী জুড়ে চলছে কালান্তক করোনার কালবেলা। অদৃশ্য এই মারণ ব্যাধির দাপটে কার্যত বেসামাল অবস্থা আমজনতার। কবে মিলবে মারণ ব্যাধির দাপট থেকে মুক্তি? এর উত্তর এখনো অজানা। গোটা বিশে^র তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও এখনো আবিষ্কার হয়নি এই রোগের কোন প্রতিষেধক। করোনাকে বশে আনতে গিয়ে কাহিল হয়ে পড়েছেন বাঘা বাঘা ভাইরোলজিস্টরাও। ফলে এই অশনি সংকেত থেকে কবে মিলবে মুক্তি?
সত্যি কথা বলতে কি আঁতুড় ঘরে এর ছুত-ছ্যামা লেগেছে। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস রোগের আঁতুড় ঘর চীনের উহান শহরে। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর প্রথমবারের মত মানবদেহে করোনাভাইরাস সনাক্ত হয়। তারপরই সারা বিশে^ তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরই মাঝে চীন দাবি করেছিলো তাদের দেশ করোনামুক্ত। কিন্তু গত সপ্তাহে বেইজিং এর একটি পাইকারি বাজারে স্যামন মাছ কাটার চপিং বোর্ডে ভাইরাসটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে পত্র-পত্রিকা জানায়। করোনার এই আক্রমণকে দ্বিতীয় ঢেউ বলা হচ্ছে। দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে চীনের রাজধানী বেইজিং এ ১৭ জুন থেকে পুণরায় ‘যুদ্ধকালিন তৎপরতা ’ শুরু হয়েছে।
চীনকে মহামারি রোগের আঁতুড় ঘর বলা হয় এই জন্য যে, ১৩৩১ সালে উয়ান সা¤্রাজ্যে এক মহামারির সুত্রপাত হয়েছিলো যার ফলে চীনে মোঙ্গল শাসনের যবনিকা ঘটেছিলো। ঠিক তিন বছর পরেই হেবেই প্রদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ প্লেগ রােগে মারা যায়। মৃতের সংখ্যা ছিলো ৫০ লাখের মত।
বিজ্ঞানীরা প্রাণির বংশগত জিনের ধারা- উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছেন, প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্লেগ নামক এবটি রোগ চীনে উৎপত্তি হয়। এই রোগে সেসময় পৃথিবীর প্রায় ১০ কোটি মানুষের প্রাণ হরণ করেছিলো। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা মেডিকেল জার্নাল-নেচার জেনেটিকসে এসব তথ্য জানিয়েছেন। গবেষকরা জানিয়েছেন, শুরুতে প্লেগ রোগের জীবাণু চীনের কাছাকাছি অথবা চীনে বিস্তার লাভ করেছিলো। পরে এরোগ বিভিন্ন পথে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। একজন চৈনিক পরিব্রাজক ঝ্যাং হের মাধ্যমে কালো মৃত্যু খ্যাত প্লেগ রোগ আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। চীনে দৃশ্যমান হওয়ার কিছুদিন পরেই প্লেগ পারস্যে আঘাত হানে।
১৮৫৫ সালে বিশ^ব্যাপি যে ‘‘ প্লেগ’’ মহামারি শুরু হয়েছিলো তার উৎপত্তিও ছিলো চীনে। সেখান থেকে এটি ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে ১০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয় এ মহামারিতে। এই মহামারি যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়ায়। ১৯০০ থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত সেখানে মহামারির তান্ডব চলে যা সানফ্রান্সিসকো প্লেগ নামে পরিচিত ছিলো।
তৃতীয় প্লেগ অতিমারি। এই অতিমারিরও শুরু চীনে। অনেকের মতে সেখান থেকেই বানিজ্য জাহাজের সংক্রমিত ইঁদুরের মাধ্যমে তা পৌঁছায় বোম্বে বন্দরে। )। (চলবে)
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।